পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

পানুবাবু সুচরিতাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, এ কথা মনে করিলে তাহার রাগ হইত।

 একটুখানি চুপ করিয়া ললিতা কথা তুলিল, “আচ্ছা, দিদি, বিনয়বাবু লোকটি কিন্তু বেশ। না?”

 সুচরিতার মনের ভাবটা যাচাই করিবার উদ্দেশ্য যে এ প্রশ্নের মধ্যে ছিল না, তাহা বলিতে পারি না।

 সুচরিতা কহিল, “হাঁ, বিনয়বাবু লোকটি ভালো বই-কি— বেশ ভালোমানুষ।”

 ললিতা যে সুর আশা করিয়াছিল তাহা তো সম্পূর্ণ বাজিল না। তখন সে আবার কহিল, “কিন্তু যাই বল দিদি, আমার গৌরমোহনবাবুকে একে- বারেই ভালো লাগে নি। কী রকম কটা কটা রঙ, কাঠখোট্টা চেহারা, পৃথিবীর কাউকে যেন গ্রাহ্যই করেন না। তোমার কিরকম লাগল?”

 সুচরিতা কহিল, “বড় বেশি রকম হিঁদুয়ানি।”

 ললিতা কহিল, “না, না, আমাদের মেলোমশায়ের তো খুবই হিঁদুয়ানি কিন্তু সে আর-এক রকমের। এ যেন— ঠিক বলতে পারি নে কিরকম।”

 সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “কী রকমই বটে।” বলিয়া গোরার সেই উচ্চ শুভ্র ললাটে তিলক-কাটা মূর্তি মনে আনিয়া সুচরিতা রাগ করিল। রাগ করিবার কারণ এই যে, ওই তিলকের দ্বারা গোরা কপালে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছে যে, ‘তোমাদের হইতে আমি পৃথক।’ সেই পার্থক্যের প্রচণ্ড অভিমানকে সুচরিতা যদি ধূলিসাৎ করিয়া দিতে পারিত তবেই তাহার গায়ের জ্বালা মিটিত।

 আলোচনা বন্ধ হইল, ক্রমে দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িল। রাত্রি যখন দুইটা সুচরিতা জাগিয়া দেখিল, বাহিরে ঝম্ ঝম্ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে; মাঝে মাঝে তাহাদের মশারির আবরণ ভেদ করিয়া বিদ্যুতের আলো চমকিয়া উঠিতেছে; ঘরের কোণে যে প্রদীপ ছিল সেটা নিবিয়া গেছে। সেই রাত্রির নিস্তব্ধতায়, অন্ধকারে, অবিশ্রাম বৃষ্টির শব্দে, সুচরিতার মনের মধ্যে একটা বেদনা বোধ

৭৮