পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

উপক্রমণিকা।

তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই সকল প্রাচীন লিপির সাহায্যে বুঝিতে পারা যায়,—প্রথম নরপালের সময়ে, সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত;—দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নরপালের সময়ে, তাহার প্রকৃত অভ্যুদয়;—চতুর্থ এবং পঞ্চম নরপালের সময় পর্য্যন্ত গৌড়মণ্ডলে পাল-নরপালগণের শাসনক্ষমতা অক্ষুণ্ণ প্রতাপে বর্ত্তমান। এই অভ্যুদয়-যুগ বাঙ্গালীর ইতিহাসের গৌরব-যুগ। এই যুগে, বরেন্দ্রমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া, [ধর্ম্মপালদেবের এবং দেবপালদেবের শাসন-সময়ে] ধীমান্‌ এবং তৎপুত্র বীতপাল গৌড়ীয় শিল্পে যে অনিন্দ্য-সুন্দর রচনা-প্রতিভা বিকশিত করিয়াছিলেন, তাহার বিবরণ “শিল্পকলায়” সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। তাহার সন্ধান-লাভে অসমর্থ হইয়া, লেখকগণ এই যুগের মগধের এবং উৎকলের শিল্প-নিদর্শনকে মগধের এবং উৎকলের প্রাদেশিক শিল্প-প্রতিভার নিদর্শন বলিয়াই ব্যাখ্যা করিয়া আসিতেছেন।

 ইহার পরবর্ত্তী যুগের [খৃষ্টীয় একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীর] বাঙ্গালীর ইতিহাসও তমসাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। অনুসন্ধান-সমিতি এই যুগের যে সকল বিবরণ সঙ্কলিত করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তদনুসারে এই দুই শত বৎসরের ইতিহাস পাঁচ ভাগে বিভক্ত হইতে পারে। কারণ, এই দুই শত বৎসরের মধ্যে, পাঁচ বার ভাগ্য-বিবর্ত্তনের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

 প্রথম ভাগে, একটি প্রবল বিপ্লবের অবসানে, পাল-সম্রাজ্যের পুনরাবির্ভাব। তাহার নায়ক প্রথম মহীপালদেব, এবং ফলভোগী তদীয় পুত্র নয়পাল এবং পৌত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল। তাঁহাদিগের কথাই একাদশ শতাব্দীর প্রধান কথা।

 দ্বিতীয় ভাগে, একটি অচিঞ্চিতপূর্ব্ব আকস্মিক প্রজা-বিদ্রোহ, রাজহত্যা, এবং কিয়ৎকালের জন্য এক কৈবর্ত্ত-রাজবংশের অভ্যুদয় ও তিরোভাব। তৎকালের প্রধান পাত্রগণের নাম [অনীতিকারম্ভ-রত] দ্বিতীয় মহীপালদেব, তাঁহার নিধনকারী [প্রজা-বিদ্রোহের নায়ক] কৈবর্ত্তপতি দিব্বোক, তদীয় ভ্রাতা রূদোক, এবং রূদোকের পুত্র ভীম রাজা।

 তৃতীয় ভাগে, কৈবর্ত্ত-বিদ্রোহের অবসানে, পাল-রাজগণের জনক-ভূমির [বরেন্দ্রের] উদ্ধার-সাধনের পর, পাল-সাম্রাজ্যের পুনরভ্যুদয় এবং অধঃপতন। এই সময়ের নরপালগণের নাম—শূরপাল, রামপাল, রামপালের পুত্র কুমারপাল, পৌত্র তৃতীয় গোপাল, এবং কুমারপালের ভ্রাতা মদনপাল।

 চতুর্থ ভাগে, সেন-রাজবংশের অভ্যুদয় এবং রাজ্য-বিস্তার; তাহার নায়ক—বিজয়সেন, বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেন, এবং পৌত্র লক্ষ্মণসেন।

 পঞ্চম ভাগ শেষভাগ,—তাহাতে বাঙ্গালা দেশে মুসলমান-অধিকার প্রচলিত হইবার সূত্রপাত।

 এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত [খৃষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর] বাঙ্গালীর ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনাবলী দেশের লোকে বিস্মৃত হইয়া গেলেও, বরেন্দ্রমণ্ডলে তাহার নানা স্মৃতিচিহ্ন বর্ত্তমান আছে। সেই সকল স্মৃতিচিহ্ন ধরিয়া, অনুসন্ধান-কার্য্যে প্রবৃত্ত না হইলে, এই দুই শত বৎসরের ইতিহাসের প্রকৃত মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম হইতে পারে না।

৷৵৹