পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/১০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গৌড়রাজমালা।

 ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে, কুতবুদ্দীন কর্ত্তৃক দীল্লি অধিকারের বৎসরে, মিন্‌হাজুদ্দীন জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন; এবং সুলতান ইয়াল্ তিমিসের এবং তাঁহার বংশধরগণের রাজত্বকালে, প্রথমে গোয়ালিয়রের এবং পরে দীল্লির প্রধান কাজির পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১২৪২ খৃষ্টাব্দে প্রধান কাজির পদ ত্যাগ করিয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বাঙ্গলায় আসিয়াছিলেন; এবং এখানে দুই বৎসরকাল অবস্থান করিয়া, দীল্লি ফিরিয়া গিয়াছিলেন। এই সুযোগেই, মিন্‌হাজ বিহার এবং বাঙ্গালার তৎকালীন ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলেন। “বিহার” এবং “নোদিয়া” অধিকারের ৪৫ বৎসর পরে, বিবরণ-সঙ্কলনে ব্রতী হইয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বৃদ্ধ সৈনিক এবং “বিশ্বস্ত লোকের” মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মিন্‌হাজুদ্দীন যখন “তবকাত্” রচনায় প্রবৃত্ত, তখন অবশ্যই পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণের প্রবর্ত্তিত প্রমাণ-পরীক্ষা-রীতি কাহারও জানা ছিল না, এবং তৎকালের জনসাধারণের ন্যায় মিন্‌হাজেরও অতিপ্রাকৃত এবং আজগুবি কথায় বিশ্বাস স্থাপনের প্রবৃত্তি যথেষ্ট ছিল। উপরন্তু, স্বধর্ম্মে অনুরাগ এবং পৌত্তলিকতায় অশ্রদ্ধা, মিন্‌হাজের ন্যায় লেখকগণকে স্বজাতির একান্ত পক্ষপাতী করিয়া রাখিয়াছিল। সুতরাং মিন্‌হাজ-বর্ণিত “বিহার” এবং “নোদিয়া”-অধিকারের বিবরণ বিশেষ বিচার পূর্ব্বক গ্রহণ করা কর্ত্তব্য।

 “বিশ্বাসী লোকের” এবং ঐ ঘটনায় লিপ্ত একজন বৃদ্ধ সৈনিকের মুখের কথা শুনিয়া, মিন্‌হাজুদ্দীন বিহার-কিল্লা অধিকারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার যখন “বিহার” আক্রমণ করেন, তখন তাঁহার অনুচরগণের মধ্যে নিজামুদ্দীন এবং সমসামুদ্দীন এই দুই ভ্রাতা ছিল। ১২৪৩ খৃষ্টাব্দে মিন্‌হাজুদ্দীন যখন “লখ্‌নাবতী” নগরে অবস্থান করিতেছিলেন, তখন সমসামুদ্দীনের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল; এবং সমসামুদ্দীনের মুখে যেরূপ শুনিয়াছিলেন, তিনি তাহাই লিথিয়া গিয়াছেন। বিহার-অধিকার-প্রসঙ্গের সূচনায় মিন্‌হাজুদ্দীন লিখিয়াছেন,—“বিশ্বাসী লোকেরা এইরূপ বলিয়াছেন যে, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার, দুই শত বর্ম্মাচ্ছাদিত-গাত্র অশ্বারোহী লইয়া, বিহারদুর্গের দ্বারদেশে উপনীত হইয়াছিলেন; এবং হঠাৎ ঐ স্থান আক্রমণ করিয়াছিলেন।” পরে সমসামুদ্দীনের উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন,—আক্রমণকারিগণ দুর্গের দ্বারে উপস্থিত হইলে, “মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার সাহসে ভর করিয়া, দ্বারের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। তাঁহারা কিল্লা অধিকার করিয়াছিলেন, এবং বিস্তর দ্রব্য লুণ্ঠিত করিয়াছিলেন। ঐ স্থানের অধিকাংশ অধিবাসী ব্রাহ্মণ ছিলেন, এবং ইঁহাদের সকলেরই মস্তক মুণ্ডিত ছিল। তাঁহারা সকলেই নিহত হইয়াছিলেন। ঐ স্থানে অনেকগুলি পুস্তক ছিল। যখন এই সকল পুস্তক মুসলমানগণের নয়নগোচর হইল, তখন উহাদের মর্ম্ম বুঝাইবার জন্য তাঁহারা কতকগুলি হিন্দুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন; কিন্তু সমস্ত হিন্দুই নিহত হইয়াছিল। যখন তাঁহারা [প্রকৃত কথা] জানিতে পারিলেন, তখন দেখা গেল—“তামাম হিসার (দুর্গ) ও সহর একটা বিদ্যালয়, এবং হিন্দী ভাষায় বিদ্যালয়কে (মাদ্‌রাসাকে) ‘বিহার’ বলে।”[১]

  1. Raverty’s Tabakat-i-Nasiri, pp. 551-552.