পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/১০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নোদিয়া-বিজয়।

সঙ্গত। শাস্ত্রের দোহাই দিয়া, সকলে নোদিয়া ছাড়িয়া সুদূর কামরূপে ও বঙ্গে পলায়ন করিলেন, কিন্তু বৃদ্ধ বীর লখ্‌মনিয়া নোদিয়া ছাড়িয়া এক পদও নড়িলেন না, একটি জনশূন্য রক্ষিশূন্য রাজধানীতে একটি বৎসর শত্রুর প্রতীক্ষায় রছিলেন। যখন শত্রু আসিল, তখন যে অপাত্রের হস্তে নগরদ্বার-রক্ষার ভার অর্পিত হইয়াছিল, তাহারা তুরূষ্ক সওয়ারগণকে ঘোড়ার সওদাগর ভ্রমে বাধা দিল না। সতত শত্রুর প্রতীক্ষাকারী নগরদ্বার-রক্ষকগণ সশস্ত্র অশ্বারোহীদিগকে ঘোড়ার সওদাগর ভ্রমে নগর প্রবেশ করিতে দেয়, মিন্‌হাজুদ্দীন ভিন্ন আর কোন ঐতিহাসিক এরূপ অদ্ভুত ঘটনা বর্ণনার অবসর পাইয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। যখন রাজভবনে প্রবেশ করিয়া, মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার হত্যাকাণ্ড আরম্ভ করিয়াছিলেন, তখন খবর পাইয়া, যদি রক্ষকহীন অশীতিবর্ষের বৃদ্ধ রাজা সরিয়া যাওয়া সঙ্গত মনে করিয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে কাপুরুষ বলা যায় না।

 তথাপি লক্ষ্মণসেনের “নোদিয়া” হইতে পলায়ন-কাহিনী প্রকৃত ঘটনা বলিয়া স্বীকার করা যায় না;—তাহা অজ্ঞ লোকের পরিকল্পিত উপকথা মাত্র। বিশ্বরূপ এবং কেশব নামক লক্ষ্মণসেনের অন্যূন দুইটি পুত্র ছিল; তিনি যাঁহাকে বালে রাজপণ্ডিত-পদ, যৌবনে প্রধান মন্ত্রি-পদ, এবং যৌবনান্তে যৌবনশেষযোগ্য ধর্ম্মাধিকারির পদ প্রদান করিয়াছিলেন, হলায়ুধের ন্যায় এরূপ হাতেগড় অমাত্য ছিল; এবং তিনি যাঁহাদিগকে লইয়া কাশী হইতে কামরূপ পর্য্যন্ত যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, এরূপ সৈন্যসামন্তও ছিল। মিন্‌হাজ লখ্‌মনিয়াকে যেরূপ প্রজারঞ্জনকারী এবং দানশীল রাজা বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে মনে হয়, তিনি অনেকের ভক্তিও আকর্ষণ করিয়াছিলেন। সুতরাং, এরূপ নৃপতিকে বার্দ্ধক্যে সকলে দল বাঁধিয়া শত্রুর দ্বারা পদদলিত হইবার জন্য “নোদিয়ায়” ফেলিয়া আসিবে, এবং এক বৎসর পর্য্যন্ত তাঁহার কোন খোঁজ খবর লইবে না, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। অনুমান হয়—যখন “ব্রাহ্মণগণ” এবং “ব্যবসায়িগণ” নোদিয়া ত্যাগ করিয়াছিলেন, “নোদিয়ার” অধীশ্বরও তখনই রাজধানী ত্যাগ করিয়া বঙ্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক এরূপ নির্ব্বিবাদে পশ্চিম-বরেন্দ্র অধিকারের প্রকৃত কারণ এই যে,—যখন মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক মগধ আক্রমণের সংবাদ বিজয়পুরে পঁহুছিয়ছিল, তখনই হয়ত ভয়াতুর মন্ত্রিবর্গের উপদেশে লক্ষ্মণসেন (পূর্ব্ব) বঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন; এবং তাহার অনতিকাল পরে [তুরূষ্ক নায়কের “দোয়ম সালে”, নোদিয়া-আক্রমণের পূর্ব্বে] পরলোক গমন করিয়া থাকিবেন। লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণের যে দুইখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার একখানিতে লক্ষ্মণসেন-পাদানুধ্যাত বিশ্বরূপসেনের নাম উৎকীর্ণ রহিয়াছে; এবং আর একখানিতে অপর একটি নাম বিলুপ্ত করিয়া, লক্ষ্মণসেন-পাদানুধ্যাত কেশবসেনের নাম উৎকীর্ণ রহিয়াছে। ইহাতে মনে হয়,—লক্ষ্মণসেনের অভাবে, সিংহাসন লইয়া পুত্রগণের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। লক্ষ্মণসেনের পরলোকগমনের অব্যবহিত পরে,—এই ভ্রাতৃবিরোধ-বহ্নি প্রধূমিত হইবার সময়ে,—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার পশ্চিম বরেন্দ্র অধিকার করিবার অবসর পাইয়া থাকিবেন।