পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গৌড়রাজমালা।

খৃষ্টাব্দে] জীবিত ছিলেন। সুতরাং প্রথম রাজেন্দ্র-চোল “ওড্‌ড বিষয়” বা উড়িষ্যা, “তক্‌কণ-লাড়ম্” বা দক্ষিণরাঢ়[১] এবং “বঙ্গাল-দেশ” বা বঙ্গ আক্রমণ করিতে গিয়া, যে মহীপালের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, সেই মহীপাল অবশ্যই পালবংশীয় গৌড়াধিপ মহীপাল। প্রথম রাজেন্দ্র-চোল প্রকৃত প্রস্তাবে মহীপালকে পরাভূত করিয়া, তাঁহার হস্তী এবং রমণীগণকে হস্তগত করিতে পারিয়াছিলেন কিনা, সুধু এক পক্ষের কথা শুনিয়া, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। কিন্তু তিরুমলয়ের লিপিতে যে ভাবে প্রথম রাজেন্দ্র-চোলের দিগ্বিজয়-বৃত্তান্ত বর্ণিত হইয়াছে, তাহা পাঠে মনে হয়, তিনি গৌড়রাজ্যের দক্ষিণাংশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। তারানাথ লিখিয়া গিয়াছেন,—উড়িষ্যার রাজা মহীপালকে করপ্রদান করিতেন।[২] চোলরাজ সম্ভবত উড়িষ্যা, বঙ্গ, এবং রাঢ়ের সামন্তগণকে পরাভূত করিয়াছিলেন; এবং মহীপালের সহিত সম্মুখযুদ্ধের পরেই হউক, বা পূর্ব্বেই হউক, আর অধিকদূর অগ্রসর হওয়া যুক্তিযুক্ত বিবেচনা না করিয়া, স্বরাজ্যে ফিরিয়া গিয়াছিলেন। দিগ্বিজয়ী চোলরাজ গৌড়রাজ্যের কোন অংশ স্থায়ীভাবে অধিকার করিয়াছিলেন, এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় না।

 মহীপাল যে উপায়েই চোলরাজের আক্রমণ হইতে গৌড়রাজ্যের উদ্ধারসাধন করিয়া থাকুন, তিনি যে সমরানুরাগী শশাঙ্ক, ধর্ম্মপাল এবং দেবপালের ন্যায় উচ্চাভিলাষী ছিলেন না, শান্তিই ভালবাসিতেন, এরূপ মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। মহীপালের গৌড়-সিংহাসনলাভের অনতিকাল পরেই, উত্তরাপথের সর্ব্বনাশের—মুসলমান-ধর্ম্মাবলম্বী তুরূষ্কগণকর্ত্তৃক উত্তরাপথ বিজয়ের—সূত্রপাত হইয়াছিল। তুরূষ্ক-আক্রমণকারিগণের গৌড়রাষ্ট্রের সীমায় পদার্পণ করিবার তখনও প্রায় দুই শতাব্দ বিলম্ব থাকিলেও, তুরূষ্কগণ কর্ত্তৃক পরিণামে গৌড়বিজয়-রহস্য উদ্‌ঘাটনার্থ, এই দুই শতাদের গৌড়রাষ্ট্রের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাপথে তুরূষ্ক-প্রভাব-বিস্তারের ইতিবৃত্তও সংক্ষেপে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়।

 খৃষ্টীয় অষ্টম শতাদের আরম্ভে (৭১১ খৃষ্টাব্দে) খালিফ-আল-ওয়ালিদের সেনানী মহম্মদ কাশিমের নেতৃত্বাধীনে মুসলমানধর্ম্মী আরবগণ সিন্ধু এবং মুলতান অধিকার করিলেও, আরব-প্রাধান্যের যুগে, মুসলমান-প্রভাব সিন্ধু ও মুলতানের বাহিরে বিস্তারলাভ করিতে পারিয়াছিল না। সেই যুগে পরাক্রান্ত সাহিরাজ্যের নৃপতিগণ উত্তরাপথের উত্তরপশ্চিম-সীমান্ত রক্ষা করিতেছিলেন। পঞ্জাব ও আফগানিস্থানের পূর্ব্বভাগ সাহিরাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সাহিরাজ্য প্রথমে কুষাণ-সম্রাট কনিষ্কের বংশধরগণের পদানত ছিল। সুতরাং সাহিরাজগণ জাতিতে তুরূষ্ক এবং সম্ভবত বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী হইলেও, কার্য্যত হিন্দুসমাজভূক্ত হইয়া গিয়াছিলেন; এবং মুসলমান-আক্রমণ হইতে

  1. রায় বাহাদুর বেঙ্কয় এবং ডাক্তার হুল্‌জ্ “তক্‌কণ-লাড়ম্” দক্ষিণ-বিরাট বা দক্ষিণ-বেরার অর্থে এবং “উত্তির-লাড়ম্” উত্তর বেরার অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু ওড্‌ড-বিষয়, বঙ্গালদেশ, এবং গঙ্গার সহিত উল্লিখিত দেখিয়া “লাড়”কে রাঢ় অর্থে গ্রহণই সমীচীনতর বোধ হয়।
  2. Cunningham’s Archæological Survey of India, Vol. III, p. 134.

৪০