পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গৌড়রাজমালা।

জেলায়) “মহীপালদীঘি”, অ্যাপি মহীপালের পরহিত-নিষ্ঠার পরিচয় দিতেছে। তিনটি সুবৃহৎ নগরের ভগ্নাবশেষ—বগুড়াজেলার অন্তর্গত “মহীপুর”, দীনাজপুর জেলার “মহীসন্তোষ”, এবং মুর্শিদাবাদ জেলার “মহীপাল”,—মহীপালের নামের সহিত জড়িত রহিয়াছে। ১০৮৩ সম্বতের (১০২৬ খৃষ্টাব্দের) সারনাথে প্রাপ্ত একখানি শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে,—গৌড়াধিপ মহীপাল বারাণসীধামে, স্থিরপাল এবং বসন্তপালের দ্বারা, ঈশান (শিব) ও চিত্রঘণ্টার (দুর্গার) মন্দিরাদি [কীর্ত্তিরত্নশতানি] প্রতিষ্ঠিত করাইয়াছিলেন; মৃগদাবের (সারনাথের) “ধর্ম্মরাজিকা” বা অশোকস্তূপ এবং অশোকের স্তম্ভোপরস্থিত “সাঙ্গ-ধর্ম্মচক্রের” জীর্ণসংস্কার করাইয়াছিলেন; এবং অভিনব “শৈলগন্ধকূটী” নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন।

 সারনাথের লিপিতে বারাণসীধামে মহীপালের কীর্ত্তিকলাপের যে তালিকা প্রদত্ত হইয়াছে, তাহা পাঠে স্বতঃই মনে হয়,—বারাণসী তখন গৌড়রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দে, গাহড়বাল-রাজগণের আমলে, বারাণসী কান্যকুব্জ রাজ্যের অন্তর্নিবিষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু একাদশ শতাব্দে, বারাণসী কান্যকুব্জের প্রতীহার-রাজগণের অধিকারভুক্ত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। একাদশ শতাব্দের প্রথম পাদে, কান্যকুব্জ-রাজ রাজ্যপাল, সুলতান মামুদের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া, যখন ঘোর বিপন্ন এবং স্বীয় রাজধানী-রক্ষণে অসমর্থ তখন বারাণসী তাঁহার রক্ষণাধীনে থাকিলে, গৌড়াধিপ যে তথায় শত শত কীর্ত্তিরত্ন-প্রতিষ্ঠায় সাহসী হইতেন, এরূপ মনে হয় না। বারাণসী তখন গৌড়রাষ্ট্রভুক্ত এবং গৌড়সেনা-রক্ষিত ছিল; এবং মহীপাল বারাণসী-রক্ষার সুব্যবস্থা করিয়া রাখিয়ছিলেন বলিয়াই, হয়ত এই মহাতীর্থ সুলতান মামুদের আক্রমণ হইতে অব্যাহতি পাইয়াছিল।[১]

  1. বেণ্ডল (Bendall) নেপাল-দরবারের পুস্তকাগারের একখানি হস্তলিখিত রামায়নের (১০৭৯ নং) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের উপসংহার-ভাগ হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন, (Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXXII, 1903, Part 1, page 18):—“সংবৎ ১০৭৬ আষাঢ়বদি ৪ মহারাজাধিরাজ পুণ্যাবলোক—সোমবংশোদ্ভব-গৌড়ধ্বজ-শ্রীমদ্-গাঙ্গেয়দেব-ভুজ্যমান-তীরভুক্তৌ কল্যাণবিজয়রাজ্যে………শ্রীগোপতিনা লেখিদম্।” বেণ্ডল সম্বৎ ১০৭৬ বিক্রম-সম্বৎ রূপে [১০১৯ খৃষ্টাব্দ] গ্রহণ করিয়া, গৌড়ধ্বজ গাঙ্গেয়দেবকে ও চেদীর কলচুরি-বংশীয় রাজা গাঙ্গেয়দেবকে অভিন্ন বলিয়া স্থির করিয়া গিয়াছেন। ১০১৯ খৃষ্টাব্দে তীরভুক্তি বা ত্রিহুত (মিথিলা) কলচুরি-রাজ গাঙ্গেয়দেবের পদানত ছিল, এ কথা স্বীকার করিতে হইলে, তখন বারাণসীকে গৌড়রাজ্যের অন্তর্গত বলিয়া মনে করা যায় না। ফরাসী পণ্ডিত লেভি, স্বরচিত নেপালের ইতিহাসে (Levi’s Le Nepal, Vol. II, p. 202, note, বঙ্গীয় এসিয়াটিক্ সোসাইটীর সুযোগ্য পুস্তকরক্ষক বন্ধুবর শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রচন্দ্র কুমার এই অংশ আমাকে অনুবাদ করিয়া দিয়াছেন), বেণ্ডলের উদ্ধৃত পাঠের বিশুদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন, এবং বেণ্ডলের ব্যাখ্যাও গ্রহণ করেন নাই। “গৌড়ধ্বজ” বা গৌড়-রাজ্যের পতাকা অর্থে গৌড়াধিপকেই বুঝাইতে পারে। চেদীর কলচুরি-বংশীয় কোনও রাজা কর্ত্তৃক কখনও গৌড়াধিপ-উপাধি ধারণের প্রমাণ বিদ্যমান নাই। চেদীরাজ গাঙ্গেয়দেবের সময়ে মগধ যে গৌড়াধিপ মহীপালের পদানত ছিল, তাহার প্রমাণ আছে, এবং মগধের পশ্চিম-দিগ্‌বর্ত্তী জেজাভুক্তি (বুন্দেলখণ্ড) চন্দেল্ল-রাজগণের অধিকৃত ছিল। সুতরাং মগধ ও জেজাভুক্তি ডিঙ্গাইয়া, চেদী-রাজের পক্ষে মিথিলায় “কল্যাণবিজয়রাজ্য”-প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নহে। নেপালী-লেখক কর্ত্তৃক উল্লিখিত এই সোমবংশীয় গাঙ্গেয়দেব হয়ত মিথিলার একজন সামন্ত নরপাল ছিলেন।

8২