লেখমালা।
(১৫)
সেই বৃহস্পতি-প্রতিকৃতি [কেদারমিশ্রের] যজ্ঞস্থলে, সাক্ষাৎ ইন্দ্র-তুল্য শত্রু-সংহারকারী নানা-সাগর-মেখলাভরণা বসুন্ধরার চির-কল্যাণকামী শ্রীশূরপাল[১] [নামক] নরপাল, স্বয়ং উপস্থিত হইয়া, অনেকবার শ্রদ্ধা-সলিলাপ্লুত-হৃদয়ে, নতশিরে, পবিত্র [শান্তি] বারি[২] গ্রহণ করিয়াছিলেন।
(১৬)
তাঁহার দেবগ্রাম-জাতা[৩] বব্বা [দেবী] নাম্নী পত্নী ছিলেন। লক্ষ্মী চঞ্চলা বলিয়া, এবং [দক্ষ-দুহিতা] সতী অনপত্যা[৪] [অপুত্রবতী] বলিয়া, তাঁহাদের সহিত [বব্বা দেবীর] তুলনা হইতে পারে না।
(১৭)
দেবকী গোপাল-প্রিয়কারক পুরুষোত্তম তনয় প্রসব করিয়াছিলেন; যশোদা সেই লক্ষ্মীপতিকে [আপন পুত্ররূপে] স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। বব্বা দেবীও, সেইরূপ, গো-পাল-প্রিয়কারক পুরুষোত্তম তনয় প্রসব করিয়াছিলেন; যশো-দাতারা[৫] তাঁহাকে লক্ষ্মীর পতি বলিয়াই স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন।
- ↑ এই শ্লোকের “শূরপালকে,” ডাক্তার হরণ্লি “প্রথম বিগ্রহপাল” বলিয়া গ্রহণ করায়, সকলেই তাহা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। অধ্যাপক কিল্হর্ণ লিখিয়া গিয়াছেন,—“As to Surapála I readily adopt Dr. Hœrnle’s suggestion that he is indentical with the Vigrahapála of the Bhágalpur copper-plate, the immediate predecessor of Náráyanapála.” (উইকিসংকলন টীকা: ১৯৭০ সালে মির্জ়াপুর তাম্রশাসন আবিষ্কারের পর থেকে এই রাজা প্রথম শূরপাল নামে আলাদা রাজা হিসেবে গণ্য।)
- ↑ অনেকে এই শ্লোকে [ডাক্তার রাজেন্দ্রলালের মতানুসরণ করিয়া,] শূরপালদেবের “অভিষেক-ক্রিয়ার” সন্ধান লাভ করিয়া থাকেন। কিন্তু “ভূয়ঃ”-শব্দ তাহার প্রবল অন্তরায়। বহুলোকে আত্মকল্যাণ-কামনায় যজ্ঞ-স্থলে উপস্থিত হইয়া, মস্তকে শান্তি-বারি গ্রহণ করিয়া থাকে। “নানাসাগর-মেখলাভরণা বসুন্ধরার চির-কল্যাণকামী” শূরপাল নামক নরপালও সেইরূপ করিতেন। “ভূয়ঃ”-শব্দে, কেদারমিশ্রের অনেক বার যজ্ঞ করিবার, এবং শূরপালদেবেরও অনেকবার [যজ্ঞ-স্থলে] মস্তকে শান্তি-বারি গ্রহণ করিবার পরিচয় প্রকাশিত হইতেছে। এই শ্লোকে যদি কোন ঐতিহাসিক তথ্য পরিস্ফুট হইয়া থাকে, তবে তাহা এই,—(১) শূরপালদেবের শাসন-সময়েও, বরেন্দ্র-মণ্ডলে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইত। (২) বৌদ্ধ-মতাবলম্বী রাজা যজ্ঞ-স্থলে উপস্থিত হইয়া, মস্তকে শান্তি-বারি গ্রহণ করিতে শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতেন; এবং (৩) তাহাতে রাজ্যের কল্যাণ হইবে বলিয়াই বিশ্বাস করিতেন। কেদারমিশ্রকে বৃহস্পতির সহিত এবং শ্রীশূরপালদেবকে ইন্দ্রদেবের সহিত তুলনা করিয়া, কবি তাহারই আভাস প্রদান করিয়া গিয়াছেন।
- ↑ মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এম, এ, [রামচরিত কাব্যের ভূমিকায়] দেবগ্রামকে নদীয়া জেলার অন্তর্গত বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন কেন, তাহার কোন কারণের উল্লেখ করেন নাই।
- ↑ এই শ্লোকের “অতুল্যা”-শব্দ রচনা-কৌশল-বিজ্ঞাপক। দক্ষ দুহিতা সতী সন্তান-লাভের পূর্ব্বেই, দক্ষ-যজ্ঞে প্রাণ বিসর্জ্জন করায়, “অনপত্যা” ছিলেন। লক্ষ্মীও চঞ্চলা বলিয়াই সুপরিচিতা। সুতরাং, ইহাদের সহিত তুলনা দিতে না পারিয়া, কবি “অতুল্যা” শব্দের প্রয়োগ করিয়াছেন।
- ↑ এই শ্লোকে শ্লিষ্ট প্রয়োগের অভাব নাই। দেবকীনন্দন-পক্ষে অর্থ সুব্যক্ত। বব্বানন্দন-পক্ষে “গো-পাল-প্রিয় কারকের” অর্থ পৃথিবী পালক “রাজার” প্রিয়কারক; “পুরুষোত্তমের” অর্থ “পুরুষশ্রেষ্ঠ”; এবং “যশোদার” অর্থ “যশোদাতা”। এই অর্থে “যশোদা”-শব্দ তৈত্তিরীয়-সংহিতায় [৪।৪।৬।২] ব্যবহৃত হইয়াছে। যথা,—
“यशोदां त्वा यशसि तेजोदां त्वा तेजसीति।”
৮২