কিছু ঘুচল বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে একটা দীর্ঘনিশ্বাসও পড়ল। নিজের জন্যে লজ্জায় নাহয় মরেই যেতুম, তবু মনে মনে যে রাজপুত্রটি ছিল তাকে একবার চোখে চোখে দেখতে পেলুম না কেন?
কিন্তু রূপ যখন চোখের পাহারা এড়িয়ে লুকিয়ে অন্তরে দেখা দেয় সেই বুঝি ভালাে। তখন সে যে ভক্তির অমরাবতীতে এসে দাঁড়ায়—সেখানে তাকে কোনাে সাজ করে আসতে হয় না। ভক্তির আপন সৌন্দর্যে সমস্তই কেমন সুন্দর হয়ে ওঠে সে আমি ছেলেবেলায় দেখেছি। মা যখন বাবার জন্যে বিশেষ করে ফলের খােসা ছাড়িয়ে সাদা পাথরের রেকাবিতে জলখাবার গুছিয়ে দিতেন, বাবার জন্যে পানগুলি বিশেষ করে কেওড়াজলের ছিটে-দেওয়া কাপড়ের টুকরােয় আলাদা জড়িয়ে রাখতেন, তিনি খেতে বসলে তালপাতার পাখা নিয়ে আস্তে আস্তে মাছি তাড়িয়ে দিতেন, তার সেই লক্ষ্মীর হাতের আদর, তাঁর সেই হৃদয়ের সুধারসের ধারা কোন্ অপরূপ রূপের সমুদ্রে গিয়ে ঝাপ দিয়ে পড়ত সে যে আমার সেই ছেলেবেলাতেও মনের মধ্যে বুঝতুম।
সেই ভক্তির সুরটি কি আমার মনের মধ্যে ছিল না? ছিল। তর্ক না, ভালাে-মন্দের তত্ত্ব-নির্ণয় না, সে কেবলমাত্র একটি সুর। সমস্ত জীবনকে যদি জীবন-বিধাতার মন্দিরপ্রাঙ্গণে একটি স্তবগান করে বাজিয়ে যাবার কোনাে সার্থকতা থাকে, তবে সেই প্রভাতের সুরটি আপনার কাজ আরম্ভ করেছিল।
মনে আছে, ভােরের বেলায় উঠে অতি সাবধানে যখন স্বামীর পায়ের ধুলাে নিতুম তখন মনে হত, আমার সিঁথির সিঁদুরটি যেন শুকতারার মতাে জ্বলে উঠল। একদিন তিনি হঠাৎ জেগে হেসে উঠে বললেন, ও কী বিমল, করছ কী! আমার সে লজ্জা ভুলতে পারব না। তিনি হয়তাে ভাবলেন, আমি লুকিয়ে পুণ্য অর্জন করছি। কিন্তু নয়, নয়, সে আমার পুণ্য নয়— সে আমার নারীর হৃদয়, তার ভালােবাসা আপনিই পূজা করতে চায়।
আমার শ্বশুর-পরিবার সাবেক নিয়মে বাঁধা। তার কতক কায়দা-কানুন মােগল-পাঠানের, কতক বিধিবিধান মনু-পরাশরের। কিন্তু আমার স্বামী একেবারে একেলে। এ বংশে তিনিই প্রথম রীতিমত লেখাপড়া শেখেন, আর এম. এ. পাস করেন। তার বড় দুই ভাই মদ খেয়ে অল্প বয়সে মারা গেছেন— তাদের ছেলেপুলে নেই। আমার স্বামী মদ খান না, তার চরিত্রে কোনাে চঞ্চলতা নেই— এ বংশে এটা এত খাপছাড়া যে সকলে এতটা পছন্দ করে না। মনে করে, যাদের ঘরে লক্ষ্মী নেই অত্যন্ত নির্মল