ওঁর এই ছলনার কথা বলবার জো ছিল না। বলতে গেলেই তিনি এমন মুখ করে চুপ করে থাকতেন যে, বুঝতুম যে উলটো ফল হল। এ-সব মানুষকে ঠকানাের হাত থেকে বাঁচাতে গেলেই ঠকতে হয়।
মেজোরানী সেলাই ভালােবাসেন; একদিন যখন সেলাই করছেন তখন আমি স্পষ্টই তাঁকে বললুম, এ তােমার কী কাণ্ড! এ দিকে তােমার ঠাকুরপাের সামনে দিশি কাঁচির নাম করতেই তােমার জিব দিয়ে জল পড়ে, ও দিকে সেলাই করবার বেলা বিলিতি কাঁচি ছাড়া যে তােমার এক দণ্ড চলে না!
মেজোরানী বললেন, তাতে দোষ হয়েছে কী? কত খুশি হয় বল দেখি। ছোটোবেলা থেকে ওর সঙ্গে যে একসঙ্গে বেড়েছি, তােদের মতাে ওকে আমি হাসিমুখে কষ্ট দিতে পারি নে। পুরুষমানুষ, ওর আর তাে কোনাে নেশা নেই— এক, এই দিশি দোকান নিয়ে খেলা, আর ওর এক সর্বনেশে নেশা তুই— এইখেনেই ও মজবে!
আমি বললুম, যাই বল, পেটে এক মুখে এক ভালাে নয়।
মেজোরানী হেসে উঠলেন; বললেন, ওলাে সরলা, তুই যে দেখি বড় বেশি সিধে, একেবারে গুরুমশায়ের বেতকাঠির মতাে! মেয়েমানুষ অত সােজা নয়— সে নরম বলেই অমন একটু-আধটু নুয়ে থাকে, তাতে দোষ নেই।
মেজোরানীর সেই কথাটি ভুলব না, ওর এক সর্বনেশে নেশা তুই, এইখেনেই ও মজবে।
আজ আমার কেবলই মনে হয়, পুরুষমানুষের একটা নেশা চাই, কিন্তু সে নেশা যেন মেয়েমানুষ না হয়।
আমাদের শুকসায়রের হাট এ জেলার মধ্যে মস্ত বড়াে হাট। এখানে জোলার এ ধারে নিত্য বাজার বসে, আর জোলার ও ধারে প্রতি শনিবারে হাট লাগে। বর্ষার পর থেকেই এই হাট বেশি করে জমে। তখন নদীর সঙ্গে জোলার যােগ হয়ে যাতায়াতের পথ সহজ হয়ে যায়। তখন সুতাে এবং আগামী শীতের জন্যে গরম কাপড়ের আমদানি খুব বেড়ে ওঠে।
সেই সময়টাতে দিশি কাপড় আর দিশি নুন-চিনির বিরােধ নিয়ে বাংলাদেশের হাটে হাটে তুমুল গণ্ডগােল বেধেছে। আমাদের সকলেরই খুব একটা জেদ চড়ে গেছে। আমাকে সন্দীপ এসে বললেন, এত বড়াে হাট-বাজার আমাদের হাতে আছে, এইটাকে আগাগােড়া স্বদেশী করে তুলতে হবে। এই এলাকা থেকে বিলিতি অলক্ষ্মীকে কুলাের হাওয়া দিয়ে বিদায় করা চাই।
আমি কোমর বেঁধে বললুম, চাই বৈকি।