পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১০৯

 জগতে অনেক খিচুড়ি পাকানাে হয়েছে, এখন—

 না গাে, তােমরা খিচুড়ি পাকাবে কেন, তোমাদের টুঁটি চেপে ধরে খিচুড়ি গেলাবে। বঙ্গবিভাগ করবে, বলবে তােমাদের সুবিধার জন্যেই। শিক্ষার দরজা এঁটে বন্ধ করতে থাকবে, বলবে তােমাদেরই আদর্শ অত্যুচ্চ করে তােলবার সদভিপ্রায়ে। তােমরা সাধু হয়ে অশ্রুপাত করতে থাকবে, আর আমরা অসাধু হয়ে মিথ্যে দুর্গ শক্ত করে বানাব। তােমাদের অশ্রু টিঁকবে না, কিন্তু আমাদের দুর্গ টিকবে।

 মাস্টারমশায় আমাকে বললেন, এ-সব তর্ক করবার কথা নয়, নিখিল। আমাদের ভিতরেই এবং সকলের মূলেই যে একটি বিরাট সত্য আছে এ কথা যে লােক নিজের ভেতর থেকেই উপলব্ধি না করতে পারে সে লােক কেমন করে বিশ্বাস করবে যে, সেই অন্তরতম সত্যকেই সমস্ত আবরণ মােচন করে প্রকাশ করাই মানুষের চরম লক্ষ্য, বাইরের জিনিসকে স্তূপাকার করে তােলা লক্ষ্য নয়।

 সন্দীপ হেসে উঠে বললে, আপনার এ কথা মাস্টারমশায়ের মতাে কথাই হয়েছে। এসব কেবল বইয়ের পাতায় দেখা যায়, চোখের পাতায় দেখছি বাইরের জিনিসকে স্তূপাকার করে তােলাই মানুষের চরম লক্ষ্য। আর, সেই লক্ষ্যকে যারা বড়াে রকম করে সাধন করেছে তারা ব্যাবসার বিজ্ঞাপনে প্রতিদিন বড়াে অক্ষরে মিথ্যা কথা বলে, তারা রাষ্ট্রনীতির সদর-খাতায় খুব মােটা কলমে জাল হিসাব লেখে, তাদের খবরের কাগজ মিথ্যার বােঝাই জাহাজ, আর মাছি যেমন করে সান্নিপাতিক জ্বরের বীজ বহন করে তাদের ধর্মপ্রচারকেরা তেমনি করে মিথ্যাকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে বেড়ায়। আমি তাদেরই শিষ্য— আমি যখন কংগ্রেসের দলে ছিলুম তখন আমি বাজার বুঝে আধ সের সত্যে সাড়ে-পনেরাে সের জল মেশাতে কিছুমাত্র লজ্জা করি নি। আজ আমি সে দল থেকে বেরিয়ে এসেছি, আজও আমি এই ধর্মনীতিকেই সার জেনেছি যে, সত্য মানুষের লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হচ্ছে ফললাভ।

 মাস্টার-মশায় বললেন, সত্যফল-লাভ।

 সন্দীপ বলল, হাঁ, সেই ফসল মিথ্যের আবাদে তবে ফলে। পায়ের নীচের মাটি একেবারে গুঁড়িয়ে ধুলাে করে দিয়ে তবে সেই ফসল ফলে। আর, যা সত্য, যা আপনি জন্মায়, সে হচ্ছে আগাছা, কাঁটাগাছ; তার থেকেই যারা ফলের আশা করছে তারা কীটপতঙ্গের দল।

 এই বলেই সন্দীপ বেগে বেরিয়ে চলে গেল। মাস্টারমশায় একটু হেসে আমার দিকে চেয়ে বললেন, জান নিখিল? সন্দীপ অধার্মিক নয়, ও বিধার্মিক।