যে কী অপূর্ব কবিত্ব আছে সে কথা প্রতিদিন সুর চড়িয়ে চড়িয়ে বলছেন। তার থেকে বােঝা যাচ্ছে, জীবনের এই জায়গায় কেমন করে সত্যে আর সুন্দরে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন কি কেবলমাত্র সুন্দরের দোহাই দিলে আর সত্যকে ফিরে পাওয়া যাবে?
মেয়েমানুষের মন সবই যে এক ছাঁচে ঢালা তা আমি মনে করি নে। কিন্তু এটুকু জানি, আমার মনের মধ্যে আমার মায়ের সেই জিনিসটি ছিল— সেই ভক্তি করবার ব্যগ্রতা। সে যে আমার সহজ ভাব তা আজকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি, যখন সেটা বাইরের দিক থেকে আর সহজ নেই। এমনি আমার কপাল, আমার স্বামী আমাকে সেই পূজার অবকাশ দিতে চাইতেন না। সেই ছিল তাঁর মহত্ত্ব। তীর্থের অর্থপিশাচ পাণ্ডা পূজার জন্যে কাড়াকাড়ি করে, কেননা সে পূজনীয় নয়। পৃথিবীতে যারা কাপুরুষ, তারাই স্ত্রীর পূজা দাবি করে থাকে। তাতে পূজারী ও পূজিত দুইয়েরই অপমানের একশেষ।
কিন্তু এত সেবা আমার জন্যে কেন? সাজসজ্জা দাসদাসী জিনিসপত্রের মধ্যে দিয়ে যেন আমার দুই কূল ছাপিয়ে তাঁর আদরের বান ডেকে বইল। এই-সমস্তকে ঠেলে আমি নিজেকে দান করব কোন্ ফাকে! আমার পাওয়ার সুযােগের চেয়ে দেওয়ার সুযােগের দরকার অনেক বেশি ছিল। প্রেম যে স্বভাববৈরাগী, সে যে পথের ধারে ধুলার ’পরে আপনার ফুল অজস্র ফুটিয়ে দেয়, সে তাে বৈঠকখানার চীনের টবে আপনার ঐশ্বর্য মেলতে পারে না। আমাদের অন্তঃপুরে যে-সমস্ত সাবেক দস্তুর চলিত ছিল আমার স্বামী তাকে সম্পূর্ণ ঠেলতে পারতেন না। দিনে-দুপুরে যখন-তখন অবাধে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হতে পারত না। আমি জানতুম ঠিক কখন তিনি আসবেন— তাই যেমন-তেমন এলােমেলাে হয়ে আমাদের মিলন ঘটতে পারত না। আমাদের মিলন যেন কবিতার মিল— সে আসত ছন্দের ভিতর দিয়ে, যতির ভিতর দিয়ে। দিনে কাজ সেরে, গা ধুয়ে, যত্ন করে চুল বেঁধে, কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে কোঁচানাে শাড়িটি পরে, ছড়িয়ে-পড়া দেহ-মনকে সমস্ত সংসার থেকে সম্পূর্ণ ফিরিয়ে এনে একজনের কাছে একটি বিশেষ সময়ের সােনার থালায় নিবেদন করে দিতুম।— সেই সময়টুকু অল্প, কিন্তু অল্পের মধ্যে সে অসীম।
আমার স্বামী বরাবর বলে এসেছেন, স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি সমান অধিকার, সুতরাং তাদের সমান প্রেমের সম্বন্ধ। এ নিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে কোনােদিন তর্ক করি নি। কিন্তু আমার মন বলে, ভক্তিতে মানুষকে সমান