পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১২৩

বুদ্ধিটাকে পরিষ্কার করে দিয়েছেন। নিজের ভিতরে কিংবা নিজের বাইরে কিছু অস্পষ্ট থাকবার জো নেই। অন্য যাকেই ভােলাই নিজেকে কখনাে ভােলাই নে। সেইজন্যে বেশিক্ষণ রাগতে পারলুম না। যেটা সত্য সেটা ভালােও নয় মন্দও নয়, সেটা সত্য, এইটেই হল বিজ্ঞান। মাটি যতটা জল শুষে নেয় সেটুকু বাদে যে জলটা থাকে সেইটে নিয়েই জলাশয়। বন্দে মাতরমের নীচের তলার মাটিতে খানিকটা জল শুষবে। সে জল আমিও শুষব, ঐ নায়েবও শুষবে— তার পরেও যেটা থাকবে সেইটেই হল বন্দে মাতরং। একে কপটতা বলে গাল দিতে পারি; কিন্তু এটা সত্য, একে মানতে হবে। পৃথিবীর সকল বড়াে কাজেরই তলায় একটা স্তর জমে যেটা কেবল পাঁক; মহাসমুদ্রের নীচেও সেটা আছে।

 তাই, বড়াে কাজ করবার সময় এই পাঁকের দাবির হিসেবটি ধরা চাই। অতএব নায়েব কিছু নেবে এবং আমারও কিছু প্রয়ােজন আছে; সে প্রয়ােজনটা বড়াে প্রয়ােজনের অন্তর্গত। কারণ, ঘােড়াই কেবল দানা খাবে তা নয়, চাকাতেও কিছু তেল দিতে হয়।

 যাই হােক, টাকা চাই। পঞ্চাশ হাজারের জন্যে সবুর করলে চলবে না। এখনই যা পাওয়া যায় তাই সংগ্রহ করতে হবে। আমি জানি, এই-সমস্ত জরুর যখন তাগিদ করে আখেরকে তখন ভাসিয়ে দিতে হয়। আজকের দিনের পাঁচ হাজার পরশু দিনের পঞ্চাশ হাজারের অঙ্কুর মুড়িয়ে খায়। আমি তাে তাই নিখিলকে বলি, যারা ত্যাগের রাস্তায় চলে তাদের লােভকে দমন করতেই হয় না, যারা লােভের রাস্তায় চলে পদে পদে তাদের লােভকে ত্যাগ করতে হয়। পঞ্চাশ হাজারকে আমি ত্যাগ করলুম, নিখিলের মাস্টারমশায় চন্দ্রবাবুকে ওটা ত্যাগ করতে হয় না।

 ছ’টা যে রিপু আছে তার মধ্যে প্রথম-দুটো এবং শেষ-দুটো হচ্ছে পুরুষের, আর মাঝখানের দুটো হচ্ছে কাপুরুষের! কামনা করব কিন্তু লােভ থাকবে না, মােহ থাকবে না। তা থাকলেই কামনা হল মাটি। মােহ জিনিসটা থাকে অতীতকে আর ভবিষ্যৎকে জড়িয়ে। বর্তমানকে পথ ভােলাবার ওস্তাদ হচ্ছে তারা। এখনই যেটা দরকার সেটাতে যারা মন দিতে পারে নি, যারা অন্য কালের বাঁশি শুনছে, তারা বিরহিণী শকুন্তলার মতাে; কাছের অতিথির হাঁক তারা শুনতে পায় না। সেই শাপে দূরের যে অতিথিকে তারা মুগ্ধ হয়ে কামনা করে তাকে হারায়। যারা কামনার তপস্বী তাদেরই জন্যে মােহমুদ্‌গর। কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ।