পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৪
ঘরে-বাইরে

 সেদিন আমি বিমলার হাত চেপে ধরেছিলুম, তারই রেশ ওর মনের মধ্যে বাজছে। আমার মনেও তার ঝংকারটা থামে নি। এই রেশটুকুকেই তাজা রেখে দিতে হবে। এইটেকেই যদি বার বার অভ্যস্ত করে মােটা করে তুলি তা হলে এখন যেটা গানের উপর দিয়ে চলছে তখন সেটা তর্কে এসে নাববে। এখন আমার কোনাে কথায় বিমলা ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করবার ফাঁক পায় না। যে-সব মানুষের মােহ জিনিসটাতে দরকার আছে তাদের বরাদ্দ বন্ধ করে কী হবে? এখন আমার কাজের ভিড়। অতএব এখনকার মতাে রসের পেয়ালার এই উপরকার আমেজ পর্যন্তই থাক্‌, তলানি পর্যন্ত গেলে গােলমাল বাধবে। যখন তার ঠিক সময় আসবে তখন তাকে অবজ্ঞা করব না। হে কামী, লােভকে ত্যাগ করাে এবং মােহকে ওস্তাদের হাতের বীণাযন্ত্রের মতাে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে তার মিহি তারে মিড় লাগাতে থাকো।

 এ দিকে কাজের আসর আমাদের জমে উঠেছে। আমাদের দলবল ভিতরে ভিতরে ছড়িয়ে গেছে। ভাই-বেরাদর বলে অনেক গলা ভেঙে শেষকালে এটা বুঝেছি, গায়ে হাত বুলিয়ে কিছুতেই মুসলমানগুলােকে আমাদের দলে আনতে পারব না। ওদের একেবারে নীচে দাবিয়ে দিতে হবে; ওদের জানা চাই, জোর আমাদেরই হাতে। আজ ওরা আমাদের ডাক মানে না, দাঁত বের করে ‘হাঁউ’ করে ওঠে; একদিন ওদের ভালুক-নাচ নাচাব।

 নিখিল বলে, ভারতবর্ষ যদি সত্যকার জিনিস হয় তা হলে ওর মধ্যে মুসলমান আছে।

 আমি বলি, তা হতে পারে, কিন্তু কোন্‌খানটাতে আছে তা জানা চাই এবং সেইখানটাতেই জোর করে ওদের বসিয়ে দিতে হবে; নইলে ওরা বিরােধ করবেই।

 নিখিল বলে, বিরােধ বাড়িয়ে বুঝি তুমি বিরােধ মেটাতে চাও?

 আমি বলি, তােমার প্ল্যান কী?

 নিখিল বলে, বিরােধ মেটাবার একটিমাত্র পথ আছে।

 আমি জানি সাধুলােকের লেখা গল্পের মতাে নিখিলের সব তর্কই শেষকালে একটা উপদেশে এসে ঠেকবেই। আশ্চর্য এই, এতদিন এই উপদেশ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু আজও এগুলােকে ও নিজেও বিশ্বাস করে। সাধে আমি বলি, নিখিল হচ্ছে একেবারে জন্ম-স্কুলবয়। গুণের মধ্যে ও খাঁটি মাল। চাঁদ সদাগরের মতাে ও অবাস্তবের শিবমন্ত্র নিয়েছে, বাস্তবের সাপের দংশনকে ও মরেও মানতে চায় না। মুশকিল এই, এদের কাছে মরাটা শেষ প্রমাণ নয়; ওরা চক্ষু বুজে ঠিক করে রেখেছে, তার উপরেও কিছু আছে।