পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১২৫

 অনেক দিন থেকে আমার মনে একটি প্ল্যান আছে; সেটা যদি খাটাবার সুযােগ পাই তা হলে দেখতে দেখতে সমস্ত দেশে আগুন লেগে যাবে। দেশকে চোখে দেখতে না পেলে আমাদের দেশের লােক জাগবে না। দেশের একটা দেবীপ্রতিমা চাই। কথাটা আমার বন্ধুদের মনে লেগেছিল; তারা বললে, আচ্ছা, একটা মূর্তি বানানাে যাক। আমি বললুম, আমরা বানালে চলবে না; যে প্রতিমা চলে আসছে তাকেই আমাদের স্বদেশের প্রতিমা করে তুলতে হবে। পূজার পথ আমাদের দেশে গভীর করে কাটা আছে; সেই রাস্তা দিয়েই আমাদের ভক্তির ধারাকে দেশের দিকে টেনে আনতে হবে।

 এই নিয়ে নিখিলের সঙ্গে কিছুদিন পূর্বে আমার খুব তর্ক হয়ে গেছে। নিখিল বললে, যে কাজকে সত্য বলে শ্রদ্ধা করি তাকে সাধন করবার জন্যে মােহকে দলে টানা চলবে না।

 আমি বললুম, মিষ্টান্নমিতরেজনাঃ। মােহ নইলে ইতর লােকের চলেই না, আর পৃথিবীর বারাে-আনা ভাগ ইতর। সেই মােহকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যেই সকল দেশে দেবতার সৃষ্টি হয়েছে— মানুষ আপনাকে চেনে।

 নিখিল বললে, মােহকে ভাঙবার জন্যেই দেবতা। রাখবার জন্যে অপদেবতা।

 আচ্ছা বেশ, অপদেবতাই সই, সেটাকে নইলে কাজ এগােয় না। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে মােহটা খাড়াই আছে; তাকে সমানে খােরাক দিচ্ছি, অথচ তার কাছ থেকে কাজ আদায় করছি নে। এই দেখাে-না, ব্রাহ্মণকে ভূদেব বলছি, তার পায়ের ধুলাে নিচ্ছি, দান-দক্ষিণের অন্ত নেই, অথচ এত বড়াে একটা তৈরি জিনিসকে বৃথা নষ্ট হতে দিচ্ছি; কাজে লাগাচ্ছি নে। ওদের ক্ষমতাটা যদি পুরাে ওদের হাতে দেওয়া যায় তা হলে সেই ক্ষমতা দিয়ে যে আমরা আজ অসাধ্য সাধন করতে পারি। কেননা, পৃথিবীতে এক-দল জীব আছে তারা পদতলচর, তাদের সংখ্যাই বেশি; তারা কোনাে কাজই করতে পারে না যদি না নিয়মিত পায়ের ধুলাে পায়, তা পিঠেই হােক আর মাথাতেই থােক। এদের খাটাবার জন্যেই মােহ একটা মস্ত শক্তি। সেই শক্তিশেলগুলােকে এতদিন আমাদের অস্ত্রশালায় শান দিয়ে এসেছি, আজ সেটা হানবার দিন এসেছে; আজ কি তাদের সরিয়ে ফেলতে পারি।

 কিন্তু নিখিলকে এ-সব কথা বােঝানাে ভারি শক্ত। সত্য জিনিসটা ওর মনে একটা নিছক প্রেজুডিসের মতাে দাঁড়িয়ে গেছে। যেন সত্য বলে কোনােএকটা বিশেষ পদার্থ আছে। আমি ওকে কতবার বলেছি, যেখানে মিথ্যাটা সত্য সেখানে মিথ্যাই সত্য। আমাদের দেশ এই কথাটা বুঝত বলেই অসংকোচে বলতে পেরেছে, অজ্ঞানীর পক্ষে মিথ্যাই সত্য। সেই মিথ্যা থেকে ভ্রষ্ট হলেই