পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১২৯

 বলতে বলতে সে চৌকির উপর থেকে মাটির উপর পড়ে গিয়ে আমার দুই পা জড়িয়ে ধরলে। তার পরে ফুলে ফুলে কান্না, কান্না, কান্না!

 এই তাে হিপনটিজম। এই শক্তিই পৃথিবী জয় করবার শক্তি। কোনাে উপায় নয়, উপকরণ নয়, এই সম্মােহন। কে বলে, সত্যমেব জয়তে! জয় হবে মােহের! বাঙালি সে কথা বুঝেছিল, তাই বাঙালি এনেছিল দশভূজার পূজা, বাঙালি গড়েছিল সিংহবাহিনীর মূর্তি। সেই বাঙালি আবার আজ মূর্তি গড়বে, জয় করবে বিশ্ব কেবল সম্মােহনে। বন্দে মাতরং!

 আস্তে আস্তে হাতে ধরে বিমলাকে চৌকির উপরে উঠিয়ে বসালুম। এই উত্তেজনার পরে অবসাদ আসবার আগেই তাকে বললুম, বাংলাদেশে মায়ের পূজা প্রতিষ্ঠা করবার ভার তিনি আমার উপরেই দিয়েছেন, কিন্তু আমি যে গরিব।

 বিমলার মুখ তখনাে লাল, চোখ তখনাে বাষ্পে ঢাকা; সে গদ্‌গদ কণ্ঠে বললে, তুমি গরিব কিসের! যার যা-কিছু আছে সব যে তােমারই। কিসের জন্যে আমার বাক্স ভরে গয়না জমে রয়েছে? আমার সমস্ত সােনা-মানিক তােমার পুজোয় নাও-না কেড়ে, আমার কিছুই দরকার নেই।

 এর আগে আর-একবার বিমলা গয়না দিতে চেয়েছিল; আমার কিছুতে বাধে না, ঐখানটায় বাধল। সংকোচটা কিসের আমি ভেবে দেখেছি। চিরদিন পুরুষই মেয়েকে গয়না দিয়ে সাজিয়ে এসেছে, মেয়ের হাত থেকে গয়না নিতে গেলে কেমন যেন পৌরুষে ঘা পড়ে।

 কিন্তু এখানে নিজেকে ভােলা চাই। আমি নিচ্ছি নে। এ মায়ের পূজা, সমস্তই সেই পূজায় ঢালব। এমন সমারােহ করে করতে হবে যে তেমন পূজা এ দেশে কেউ কোনােদিন দেখে নি। চিরদিনের মতাে নূতন বাংলার ইতিহাসের মর্মের মাঝখানে এই পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই পূজাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠদান-রূপে দেশকে দিয়ে যাব। দেবতার সাধনা করে দেশের মূর্খেরা, দেবতার সৃষ্টি করবে সন্দীপ।

 এ তাে গেল বড়াে কথা। কিন্তু ছােটো কথাও যে পাড়তে হবে। আপাতত তিন হাজার টাকা না হলে তাে চলবেই না, পাঁচ হাজার হলেই বেশ সুডােল ভাবে চলে। কিন্তু এত বড়াে উদ্দীপনার মুখে হঠাৎ এই টাকার কথাটা কি বলা চলে? কিন্তু আর সময় নেই।

 সংকোচের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ফেললুম, রানী, এ দিকে যে ভাণ্ডার শূন্য হয়ে এল, কাজ বন্ধ হয় বলে!

 অমনি বিমলার মুখে একটা বেদনার কুঞ্চন দেখা দিল। আমি বুঝলুম,