পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৩৯

জয় করেছিলেন, আলেক্‌জাণ্ডার করেন নি— এ কথা যে তখন মিথ্যেকথা যখন এটা শুকনাে গলায় বলি। এই কথা কবে গান গেয়ে বলতে পারব? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই-সব প্রাণের কথা ছাপার বইকে ছাপিয়ে পড়বে কবে, একেবারে গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গার নির্ঝরের মতাে?

 হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মাস্টারমশায় কদিন ছিলেন না, কোথায় ছিলেন তা জানিও নে। একটু লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি ছিলেন কোথায়?

 মাস্টার-মশায় বললেন, পঞ্চুর বাড়িতে।

 পঞ্চুর বাড়িতে? এই চারদিন সেখানেই ছিলেন?

 হ্যাঁ, মনে ভাবলুম, যে মেয়েটি পঞ্চুর মামী সেজে এসেছে তার সঙ্গেই কথাবার্তা কয়ে দেখব। আমাকে দেখে প্রথমটা সে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল। ভদ্রলােকের ছেলে হয়েও যে এত বড়াে অদ্ভুত কেউ হতে পারে, এ কথা সে মনে করতেও পারে নি। দেখলে যে আমি রয়েই গেলুম। তার পরে তার লজ্জা হতে লাগল। আমি তাকে বললুম, মা, আমাকে তাে তুমি অপমান করে তাড়াতে পারবে না। আর আমি যদি থাকি তা হলে পঞ্চুকেও রাখব। ওর মা-হারা সব ছােটো ছােটো ছেলেমেয়ে, তারা পথে বেরােবে, এ তাে আমি দেখতে পারব না। দুদিন আমার কথা চুপ করে শুনলে; হাঁও বলে না, নাও বলে না; শেষকালে আজ দেখি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধছে। বললে, আমরা বৃন্দাবনে যাব, আমাদের পথ-খরচ দাও। বৃন্দাবনে যাবে না জানি, কিন্তু একটু মােটারকম পথ-খরচ দিতে হবে। তাই তােমার কাছে এলুম।

 আচ্ছা, সে যা দরকার তা দেব।

 বুড়িটা লােক খারাপ নয়। পঞ্চু ওকে জলের কলসী ছুঁতে দেয় না, ঘরে এলে হাঁ-হাঁ করে ওঠে, তাই নিয়ে ওর সঙ্গে খুঁটিনাটি চলছিল। কিন্তু ওর হাতে আমার খেতে আপত্তি নেই শুনে আমাকে যত্নের একশেষ করেছে। চমৎকার রাঁধে। আমার উপরে পঞ্চুর ভক্তিশ্রদ্ধা যা একটুখানি ছিল তাও এবার চুকে গেল। আগে ওর ধারণা ছিল, অন্তত আমি লােকটা সরল। কিন্তু এবার ওর ধারণা হয়েছে, আমি যে বুড়িটার হাতে খেলুম সেটা কেবল তাকে বশ করবার ফন্দি। সংসারে ফন্দিটা চাই বটে, কিন্তু তাই বলে একেবারে ধর্মটা খােওয়ানাে! মিথ্যে সাক্ষিতে আমি বুড়ির উপর যদি টেক্কা দিতে পারতুম তা হলে বটে বােঝা যেত। যা হােক, বুড়ি বিদায় হলেও কিছুদিন আমাকে পঞ্চুর ঘর আগলে থাকতে হবে— নইলে হরিশ কুণ্ডু কিছু একটা সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসবে। সে নাকি ওর পারিষদদের কাছে বলেছে, আমি ওর