পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৪
ঘরে-বাইরে

মারাও ওর পক্ষে শক্ত, অথচ মুখের কথা একেবারে অন্য জাতের। আসল কথা, এই সংসারে বুড়াে খাজাঞ্চি যে কতখানি সত্য তা ও একেবারে দেখতে পাচ্ছে না, সেখানে যেন ফাঁকা আকাশ। সেই আকাশে প্রাণ নেই, ব্যথা নেই, কেবল শ্লোক আছে: ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।

 আমি বললুম, বলাে কী অমূল্য! আমাদের রায়-মশায়ের যে স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে— তার যে—

 স্ত্রী নেই, ছেলেমেয়ে নেই, এমন মানুষ এ দেশে পাব কোথায়? দেখুন আমরা যাকে দয়া বলি, সে কেবল নিজের ’পরেই দয়া। পাছে নিজের দুর্বল মনে ব্যথা লাগে সেইজন্যেই অন্যকে আঘাত করতে পারি নে, এই তাে হল কাপুরুষতার চূড়ান্ত।

 সন্দীপের মুখের বুলি বালকের মুখে শুনে বুক কেঁপে উঠল। ও যে নিতান্ত কাঁচা, ভালোকে ভালাে বলে বিশ্বাস করবারই যে ওর সময়। আহা, ওর যে বাঁচবার বয়েস, বাড়বার বয়েস। আমার ভিতরে মা জেগে উঠল যে। নিজের দিক থেকে আমার ভালােও ছিল না, মন্দও ছিল না; ছিল কেবল মরণ মধুর রূপ ধরে। কিন্তু যখন এই আঠারাে বছরের ছেলে এমন অনায়াসে মনে করতে পারলে একজন বুড়াে মানুষকে বিনা দোষে মেরে ফেলাই ধর্ম, তখন আমার গা শিউরে উঠল। যখন দেখতে পেলুম ওর মনে পাপ নেই, তখন ওর এই কথার পাপ বড়াে ভয়ংকর হয়ে আমার কাছে দেখা দিলে। যেন বাপ-মায়ের অপরাধকে কচি ছেলের মতাে দেখতে পেলুম।

 বিশ্বাসে-উৎসাহে-ভরা বড়াে বড়াে ঐ দুটি সরল চোখের দিকে চেয়ে আমার প্রাণের ভিতর কেমন করতে লাগল। অজগর সাপের মুখের মধ্যে ঢুকতে চলেছে, একে কে বাঁচাবে?— আমার দেশ কেন সত্যিকার মা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এই ছেলেটিকে বুকে চেপে ধরছে না? কেন একে বলছে না, ওরে বাছা, আমাকে তুই বাঁচিয়ে কী করবি, তােকে যদি বাঁচাতে না পারলুম?

 জানি, জানি, পৃথিবীর বড়াে বড়াে প্রতাপ শয়তানের সঙ্গে রফা করে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু মা যে আছে একলা দাঁড়িয়ে এই শয়তানের সমৃদ্ধিকে তুচ্ছ করবার জন্যে। মা তাে কার্যসিদ্ধি চায় না, সে সিদ্ধি যত বড়াে সিদ্ধিই হােক; মা যে বাঁচাতে চায়। আজ আমার সমস্ত প্রাণ চাচ্ছে এই ছেলেটিকে দুই হাতে টেনে ধরে বাঁচাবার জন্যে।

 কিছু আগেই ওকে ডাকাতি করতে বলেছিলুম, এখন যত বড়ো উলটো কথাই বলি সেটাকে ও মেয়েমানুষের দুর্বলতা বলে হাসবে। মেয়েমানুষের দুর্বলতাকে ওরা তখনই মাথা পেতে নেয় যখন সে পৃথিবী মজাতে বসে।