পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৬
ঘরে-বাইরে

 সেই অপদেবতা একদিন রাঙা মশাল হাতে করে এসে আমাকে বললে, আমিই তােমার দেশ, আমিই তােমার সন্দীপ, আমার চেয়ে বড়াে তােমার আর কিছুই নেই! বন্দে মাতরং!

 আমি হাত জোড় করে বললুম, তুমিই আমার ধর্ম, তুমিই আমার স্বর্গ, আমার যা-কিছু আছে সব তােমার প্রেমে ভাসিয়ে দেব! বন্দে মাতরং!

 পাঁচ হাজার চাই? আচ্ছা, পাঁচ হাজারই নিয়ে যাব। কালই চাই? আচ্ছা, কালই পাবে। কলঙ্কে দুঃসাহসে ঐ পাঁচ হাজার টাকা দান মদের মতাে ফেনিয়ে উঠবে— তার পরে মাতালের উৎসব— অচলা পৃথিবী পায়ের তলায় টলমল করতে থাকবে, চোখের উপর আগুন ছুটবে, কানের ভিতর দিয়ে ঝড়ের গর্জন জাগবে, সামনে কী আছে কী নেই তা বুঝতেই পারব না তার পরে টলতে টলতে পড়ব গিয়ে মরণের মধ্যে। সমস্ত আগুন এক নিমেষে নিবে যাবে, সমস্ত ছাই হাওয়ায় উড়বে, কিছুই আর বাকি থাকবে না।


টাকা কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে কথা এর আগে কোনােমতেই ভেবে পাচ্ছিলুম না। সেদিন তীব্র উত্তেজনার আলােতে এই টাকাটা হঠাৎ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ দেখতে পেলুম।

 ফি বছর আমার স্বামী পুজোর সময় তাঁর বড়ো ভাজ আর মেজো ভাজকে তিন হাজার টাকা করে প্রণামী দিয়ে থাকেন। সেই টাকা বছরে বছরে তাঁদের নামে ব্যাঙ্কে জমা হয়ে সুদে বাড়ছে। এবারেও নিয়মমত প্রণামী দেওয়া হয়েছে কিন্তু জানি টাকাটা এখনাে ব্যাঙ্কে পাঠানাে হয় নি। কোথায় আছে তাও আমার জানা। আমাদের শােবার ঘরের সংলগ্ন কাপড় ছাড়বার ছােটো কুঠরির কোণে লােহার সিন্দুক আছে, তারই মধ্যে টাকাটা তােলা হয়েছে।

 ফি বছর এই টাকা নিয়ে আমার স্বামী কলকাতায় ব্যাঙ্কে জমা দিতে যান, এবারে তাঁর আর যাওয়া হল না। এইজন্যেই তাে দৈবকে মানি। ঐ টাকা দেশ নেবেন বলেই আটক আছে, এ টাকা ব্যাঙ্কে নিয়ে যায় সাধ্য কার! আর, এই টাকা আমি না নিই এমন সাধ্যই বা আমার কই। প্রলয়ংকরী খর্প‌র বাড়িয়ে দিয়েছেন; বলছেন, আমি ক্ষুধিত, আমাকে দে! আমি আমার বুকের রক্ত দিলুম, ঐ পাঁচ হাজার টাকায়। মা গাে, এই টাকা যার গেল তার সামান্যই ক্ষতি হবে কিন্তু আমাকে এবার তুমি একেবারে ফতুর করে নিলে।

 এর আগে কত দিন বড়ােরানী মেজোরানীকে আমি মনে মনে চোর বলেছি— আমার বিশ্বাসপরায়ণ স্বামীকে ভুলিয়ে তারা ফাঁকি দিয়ে কেবল