পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৮
ঘরে-বাইরে

পর। আমি যদি ভিক্ষে করে দেশের সেবা করতুম, এবং সেই সেবা সম্পূর্ণ না করেও মরে যেতুম, তবে সেই অসমাপ্ত সেবাই হত পুজো; দেবতা তা গ্রহণ করতেন। কিন্তু চুরি তাে পূজা নয়; এ জিনিস কেমন করে দেশের হাতে তুলে দেব? চোরাই মালে দেশের ভরা ডােবাতে বসলুম গাে! নিজে মরতে বসেছি, কিন্তু দেশকে আঁকড়ে ধরে তাকে সুদ্ধ কেন অশুচি করি!

 এ টাকা লােহার সিন্দুকে ফেরবার পথ বন্ধ। আবার এই রাত্রে সেই ঘরে ফিরে গিয়ে সেই চাবি নিয়ে সেই সিন্দুক খােলবার শক্তি আমার নেই। আমি তা হলে স্বামীর ঘরের চৌকাঠের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। এখন সামনে রাস্তা ছাড়া রাস্তাই নেই।

 কত টাকা নিলুম তাই যে বসে বসে গুনব সে আমি লজ্জায় পারলুম না। ও যেমন ঢাকা আছে তেমনি ঢাকা থাক্‌, চুরির হিসেব করব না।

 শীতের অন্ধকার রাত্রে আকাশে একটুও বাষ্প ছিল না; সমস্ত তারাগুলি ঝক্‌ ঝক্‌ করছে। আমি ছাদের উপর শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম: দেশের নাম করে ঐ তারাগুলি যদি একটি একটি মােহরের মতাে আমাকে চুরি করতে হত, অন্ধকারের বুকের মধ্যে সঞ্চিত ঐ তারাগুলি, তার পরদিন থেকে চিরকালের জন্যে রাত্রি একেবারে বিধবা, নিশীথের আকাশ একেবারে অন্ধ, তা হলে সে চুরি যে সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি হত। আজ আমি এই-যে চুরি করে আনলুম এও তাে টাকা চুরি নয়, এ যে আকাশের চিরকালের আলাে চুরিরই মতাে; এ চুরি সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি; বিশ্বাস চুরি, ধর্ম চুরি।

 ছাদের উপর পড়ে রাত্রি কেটে গেল। সকালে যখন বুঝলুম আমার স্বামী এতক্ষণে উঠে চলে গেছেন তখন সর্বাঙ্গে শাল মুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে গেলুম। তখন মেজোরানী ঘটিতে করে তাঁর বারান্দার টবের গাছ-কটিতে জল দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ওলাে ছােটোরানী, শুনেছিস খবর?

 আমি চুপ করে দাঁড়ালুম, আমার বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল। মনে হতে লাগল, আঁচলে বাধা গিনিগুলাে শালের ভিতর থেকে বড়াে বেশি উঁচু হয়ে আছে। মনে হল, এখনই আমার কাপড় ছিঁড়ে গিনিগুলাে বারান্দাময় ঝন্ ঝন্ করে ছড়িয়ে পড়বে; নিজের ঐশ্বর্য চুরি করে ফতুর হয়ে গেছে এমন চোর আজ এই বাড়ির দাসী-চাকরদের কাছেও ধরা পড়ে যাবে।

 মেজোরানী বললেন, তােদের দেবীচৌধুরানীর দল ঠাকুরপাের তহবিল লুঠ করবে শাসিয়ে বেনামি চিঠি লিখেছে।