পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৫৫

একটা উপায় করতে হবে। কী হতে পারে, কী করা যেতে পারে, এই কথা যখন বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করছি তখন মেজোরানীর বকুনি আমার কাছে অত্যন্ত অসহ্য বােধ হতে লাগল। বিশেষত আমি জানি, মেজোরানীর চোখে কিছুই এড়ায় না। তিনি ক্ষণে ক্ষণে আমার মুখের দিকে চাচ্ছিলেন, কী দেখছিলেন জানি নে; কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমার মুখে যেন সমস্ত কথাই স্পষ্ট ধরা পড়ছিল।

 দুঃসাহসের অন্ত নেই। আমি যেন নিতান্ত সহজ কৌতুকে হেসে উঠলুম; বলে উঠলুম, আসল কথা আমার ’পরেই মেজোরানীর যত অবিশ্বাস, চোর ডাকাত সমস্ত বাজে কথা।

 মেজোরানী মুচকে হেসে বললেন, তা ঠিক বলেছিস লাে, মেয়েমানুষের চুরি বড়াে সর্বনেশে। তা আমার কাছে ধরা পড়তেই হবে, আমি তাে আর পুরুষ-মানুষ নই! আমাকে ভােলাবি কী দিয়ে?

 আমি বললুম, তােমার মনে এতই যদি ভয় থাকে তবে আমার যা-কিছু আছে তােমার কাছে নাহয় জামিন রাখি, যদি কিছু লােকসান করি তাে কেটে নিয়াে।

 মেজোরানী হেসে বললেন, শােনাে একবার, ছােটোরানীর কথা শোনো। এমন লােকসান আছে যা ইহকাল-পরকালে জামিন দিয়ে উদ্ধার হয় না।

 আমাদের এই কথাবার্তার মধ্যে আমার স্বামী একটি কথাও বললেন না। তাঁর খাওয়া হয়ে যেতেই তিনি বাইরে চলে গেলেন, আজকাল তিনি আর বিশ্রাম করতে ঘরের মধ্যে বসেন না।

 আমার অধিকাংশ দামি গয়না ছিল খাজাঞ্চির জিম্মায়। তবু আমার নিজের কাছে যা ছিল তার দাম ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার কম হবে না। আমি সেই গয়নার বাক্স নিয়ে মেজোরানীর কাছে খুলে দিলুম। বললুম, মেজোরানী, আমার এই গয়না রইল তােমার কাছে। এখন থেকে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।

 মেজোরানী গালে হাত দিয়ে বললেন, ওমা, তুই যে অবাক করলি। তুই কি সত্যি ভাবিস, তুই আমার টাকা চুরি করবি এই ভয়ে রাত্রে আমার ঘুম হচ্ছে না?

 আমি বললুম, ভয় করতেই বা দোষ কী? সংসারে কে কাকে চেনে বলাে, মেজোরানী!

 মেজোরানী বললেন, তাই আমাকে বিশ্বাস করে শিক্ষা দিতে এসেছ বুঝি? আমার নিজের গয়না কোথায় রাখি ঠিক নেই, তােমার গয়না পাহারা