পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২
ঘরে-বাইরে

ভারি ইচ্ছে হত, তিনি যেন কোনো ছুতো করে বলেন, না, আমি যেতে পারব না। যা মন্দ তার তো একটা শাস্তি পাওনা আছে। কিন্তু ফি বারেই যখন তিনি হাসিমুখে নিমন্ত্রণ রাখতে যেতেন আমার মনের মধ্যে একটু কেমন— সে আমার অপরাধ— কিন্তু কী করব, আমার মন মানত না— মনে হত, এর মধ্যে পুরুষ-মানুষের একটু চঞ্চলতা আছে। সে সময়টাতে আমার অন্য সহস্র কাজ থাকলেও কোনো-একটা ছুতো করে আমার মেজো জায়ের ঘরে গিয়ে বসতুম। মেজো জা হেসে হেসে বলতেন— বাস্ রে, ছোটোরানীর একদণ্ড চোখের আড়াল হবার জো নেই— একেবারে কড়া পাহারা! বলি, আমাদেরও তো একদিন ছিল, কিন্তু এত করে আগলে রাখতে শিখি নি।

 আমার স্বামী এঁদের দুঃখটাই দেখতেন, দোষ দেখতে পেতেন না। আমি বলতুম, আচ্ছা, না হয় যত দোষ সবই সমাজের, কিন্তু অত বেশি দয়া করবার দরকার কী? মানুষ না হয় কিছু কষ্টই পেলে, তাই বলেই কি— কিন্তু তাঁর সঙ্গে পিরবার জো নেই। তিনি তর্ক না করে একটুখানি হাসতেন। বোধ হয় আমার মনের মধ্যে যে একটুখানি কাটা ছিল সেটুকু তাঁর অজানা ছিল না। আমার রাগের সত্যিকার ঝাজটুকু সমাজের উপরেও না, আর-কারো উপরেও না, সে কেবল— সে আর বলব না।

 স্বামী একদিন আমাকে বোঝালেন— তোমার এই যে-সমস্তকে ওরা মন্দ বলছে যদি সত্যিই এগুলিকে মন্দ জানত তা হলে এতে ওদের এত রাগ হত না।

 তা হলে এমন অন্যায় রাগ কিসের জন্যে?

 অন্যায় বলব কেমন করে? ঈর্ষা জিনিসটার মধ্যে একটি সত্য আছে, সে হচ্ছে এই যে, যা-কিছু সুখের সেটি সকলেরই পাওয়া উচিত ছিল।

 তা, বিধাতার সঙ্গে ঝগড়া করলেই হয়, আমার সঙ্গে কেন?

 বিধাতাকে যে হাতের কাছে পাওয়া যায় না।

 তা, ওঁরা যা পেতে চান তা নিলেই হয়। তুমি তো বঞ্চিত করতে চাও না। পরুন-না শাড়ি জ্যাকেট গয়না জুতো মোজা, মেমের কাছে পড়তে চান তো সে তো ঘরেই আছে, আর বিয়েই যদি করতে চান— তুমি তো বিদ্যেসাগরের মতো অমন সাতটা সাগর পেরোতে পার তোমার এমন সম্বল আছে।

 ঐ তো মুশকিল— মন যা চায় তা হাতে তুলে দিলেও নেবার জো নেই।

 তাই বুঝি কেবল ন্যাকামি করতে হয়? যেন যেটা পাই নি সেটা মন্দ, অথচ অন্য কেউ পেলে সর্বশরীর জ্বলতে থাকে।