পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৬
ঘরে-বাইরে

দিয়ে মরি আর-কি। চার দিকে দাসী চাকর ঘুরছে, তােমার ও গয়না তুমি নিয়ে যাও ভাই।

 মেজোরানীর কাছ থেকে চলে এসেই বাইরের বৈঠকখানা-ঘরে অমূল্যকে ডেকে পাঠালুম। অমূল্যর সঙ্গে সঙ্গে দেখি সন্দীপ এসে উপস্থিত। আমার তখন দেরি করবার সময় ছিল না; আমি সন্দীপকে বললুম, অমূল্যর সঙ্গে আমার একটু বিশেষ কথা আছে, আপনাকে একবার—

 সন্দীপ কাষ্ঠহাসি হেসে বললে, অমূল্যকে আমার থেকে আলাদা করে দেখ নাকি? তুমি যদি আমার কাছ থেকে ওকে ভাঙিয়ে নিতে চাও তা হলে আমি ওকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না।

 আমি এ কথার কোনাে উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম।

 সন্দীপ বললে, আচ্ছা বেশ, অমূল্যর সঙ্গে তােমার বিশেষ কথা শেষ করে নিয়ে তার পরে আমার সঙ্গেও একটু বিশেষ কথা কবার অবসর দিতে হবে কিন্তু। নইলে আমার হার হবে। আমি সব মানতে পারি, হার মানতে পারি নে। আমার ভাগ সকলের ভাগের বেশি। এই নিয়ে চিরজীবন বিধাতার সঙ্গে লড়ছি। বিধাতাকে হারাব, আমি হারব না।

 তীব্র কটাক্ষে অমূল্যকে আঘাত করে সন্দীপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 অমূল্যকে বললুম, লক্ষ্মী ভাই আমার, তােমাকে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে।

 সে বললে, তুমি যা বলবে আমি প্রাণ দিয়ে করব দিদি।

 শালের ভিতর থেকে গয়নার বাক্স বের করে তার সামনে রেখে বললুম, আমার এই গয়না বন্ধক দিয়ে হােক, বিক্রি করে হােক, আমাকে ছ হাজার টাকা যত শীঘ্র পার এনে দিতে হবে।

 অমূল্য ব্যথিত হয়ে বলে উঠল, না দিদি না, গয়না বিক্রি-বন্ধক না, আমি তােমাকে ছ হাজার টাকা এনে দেব।

 আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ও-সব কথা রাখাে। আমার আর একটুও সময় নেই। এই নিয়ে যাও গয়নার বাক্স। আজ রাত্রের ট্রেনেই কলকাতা যাও, পরশুর মধ্যে ছ হাজার টাকা আমাকে এনে দিতে হবে।

 অমূল্য বাক্সের ভিতর থেকে হীরের চিকটা আলােতে তুলে ধরে আবার বিষণ্ণমুখে রেখে দিলে। আমি বললুম, এই-সব হীরের গয়না ঠিক দামে সহজে বিক্রি হবে না, সেইজন্যে আমি তােমাকে যে গয়না দিচ্ছি এর দাম ত্রিশ হাজারেরও বেশি হবে। এ সবই যদি যায় সেও ভালাে— কিন্তু ছ হাজার টাকা আমার নিশ্চয়ই চাই।