পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৬১

আমি হিঁচড়ে-মিচড়ে তার একটা বাংলা করেছিলুম, কিন্তু সেটা এমন হল না ‘গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি’। এক সময়ে ঠাউরেছিলুম কবি হলেম বুঝি, আর দেরি নেই। বিধাতা দয়া করে আমার সে ফাঁড়া কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের দক্ষিণাচরণ, সে যদি আজ নিমক-মহালের ইন্‌স্পেক্টর না হত তা হলে নিশ্চয় কবি হতে পারত; সে খাসা তর্জমাটি করেছিল; পড়ে মনে হয়, ঠিক যেন বাংলাভাষা পড়ছি; যে দেশ জিয়ােগ্রাফিতে নেই এমন কোনাে দেশের ভাষা নয়—

আমায় ভালাে বাসবে না সে এই যদি তার ছিল জানা,
তবে কি তার উচিত ছিল আমার পানে দৃষ্টি হানা?
তেমন-তেমন অনেক মানুষ আছে তাে এই ধরাধামে
(যদিচ ভাই, আমি তাদের গনি নেকো মানুষ নামে)—
যাদের কাছে সে যদি তার খুলে দিত প্রাণের ঢাকা,
তবু তারা রইত খাড়া যেমন ছিল তেমনি ফাঁকা।
আমি তাে নই তাদের মতন সে কথা সে জানত মনে।
যখন মােরে বাঁধল ধরে বিদ্ধ করে নয়নকোণে।

 মক্ষীরানী, তুমি মিথ্যে খুঁজছ— নিখিল বিবাহের পর থেকে কবিতা-পড়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, বােধ হয় ওর আর দরকার হয় না। আমি ছেড়ে দিয়েছিলুম কাজের তাড়ায়, কিন্তু বােধ হচ্ছে যেন ‘কাব্যজ্বরাে মনুষ্যাণাং’ আমাকে ধরবে ধরবে করছে।

 আমার স্বামী বললেন, আমি তােমাকে সতর্ক করে দিতে এসেছি, সন্দীপ।

 সন্দীপ বললে, কাব্যজ্বর সম্বন্ধে?

 স্বামী ঠাট্টায় যােগ না দিয়ে বললেন, কিছুদিন ধরে ঢাকা থেকে মৌলবি আনাগােনা করতে আরম্ভ করেছে, এ অঞ্চলের মুসলমানদের ভিতরে ভিতরে খেপিয়ে তােলবার উদ্‌যােগ চলছে। তােমার উপর ওরা বিরক্ত হয়ে আছে, হঠাৎ একটা-কিছু উৎপাত করতে পারে।

 পালাতে পরামর্শ দাও নাকি?

 আমি খবর দিতে এসেছি, পরামর্শ দিতে চাই নে।

 আমি যদি এখানকার জমিদার হতুম তা হলে ভাবনার কথা হত মুসলমানদেরই, আমার নয়। তুমি আমাকেই উদ্‌বিগ্ন করে না তুলে ওদের দিকে যদি একটু উদ্‌বেগের চাপ দাও তা হলে সেটা তােমার এবং আমার উভয়েরই যােগ্য হয়। জান, তােমার দুর্বলতায় পাশের জমিদারদের পর্যন্ত তুমি দুর্বল করে তুলেছ?