পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৭৫

 আমি চমকে উঠলুম। বললুম, তা হলে অমূল্য যায় নি?

 কোথায় যায় নি?

 কলকাতায়?

 সন্দীপ একটু হেসে বলল, না।

 বাঁচলুম। আমার ভাইফোঁটা বাঁচল। আমি চোর, বিধাতার দণ্ড ঐ পর্যন্তই পৌঁছােক— অমূল্য রক্ষা পাক্‌।

 সন্দীপ আমার মুখের ভাব দেখে বিদ্রূপ করে বললে, এত খুশি রানী? গয়নার বাক্সের এত দাম? তবে কোন্ প্রাণে গয়না দেবীর পূজায় দিতে চেয়েছিলে? দিয়ে তাে ফেলেছ, দেবতার হাত থেকে আবার কি ফিরিয়ে নিতে চাও?

 অহংকার মরতে মরতেও ছাড়ে না। ইচ্ছে হল দেখিয়ে দিই, এ গয়নার ’পরে আমার সিকি পয়সার মমতা নেই। আমি বললুম, এ গয়নায় আপনার যদি লােভ থাকে নিয়ে যান-না।

 সন্দীপ বললে, আজ বাংলাদেশে যেখানে যত ধন আছে সমস্তর ’পরেই আমার লােভ। লােভের মতাে এত বড়াে মহৎ বৃত্তি কি আর কিছু আছে? পৃথিবীর যারা ইন্দ্র লােভ তাদের ঐরাবত। তা হলে এ-সমস্ত গয়না আমার?

 এই বলে সন্দীপ বাক্সটি তুলে নিয়ে শালের মধ্যে ঢাকা দিতেই অমূল্য ঘরের মধ্যে ঢুকল। তার চোখের গােড়ায় কালি পড়েছে, মুখ শুকনাে, উষ্কখুষ্ক চুল। একদিনেই তার তরুণ-বয়সের লাবণ্য যেন ঝরে গিয়েছে। তাকে দেখবামাত্রই আমার বুকের ভিতরটায় কামড়ে উঠল।

 অমূল্য আমার দিকে না তাকিয়েই একেবারে সন্দীপকে গিয়ে বললে, আপনি গয়নার বাক্স আমার তােরঙ্গ থেকে বের করে এনেছেন?

 গয়নার বাক্সটা তােমারই নাকি?

 না, কিন্তু তােরঙ্গ আমার।

 সন্দীপ হা হা করে হেসে উঠল। বললে, তােরঙ্গ সম্বন্ধে আমি-তুমির ভেদবিচার তাে তােমার বড়াে সূক্ষ্ম হে অমূল্য! তুমিও মরবার আগে ধর্মপ্রচারক হয়ে মরবে দেখছি।

 অমূল্য চৌকির উপর বসে পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে টেবিলের উপর মাথা রাখলে। আমি তার কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখে বললুম, অমূল্য, কী হয়েছে?

 তখনই সে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, দিদি, এ গয়নার বাক্স আমিই নিজের