পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৮
ঘরে-বাইরে

 অমূল্য লিখেছে, সে আজ সন্ধ্যার মধ্যে ফিরবে। ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে একা বসে চুপ করে থাকতে পারি নে। আবার পিঠে তৈরি করতে গেলুম। যা তৈরি হয়েছে তা যথেষ্ট, কিন্তু আরাে করতে হবে। এত কে খাবে? বাড়ির সমস্ত দাসী-চাকরদের খাইয়ে দেব। আজ রাত্রেই খাওয়াতে হবে। আজ রাত পর্যন্ত আমার দিনের সীমা। কালকের দিন আর আমার হাতে নেই।

 পিঠের পর পিঠে ভাজছি, বিশ্রাম নেই। এক-একবার মনে হচ্ছে, যেন উপরে আমার মহলের দিকে কী-একটা গােলমাল চলছে। হয়তাে আমার স্বামী লােহার সিন্দুক খুলতে এসে চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই নিয়ে মেজোরানী দাসী-চাকরকে ডেকে একটা তােলপাড় কাণ্ড বাধিয়েছেন। না, আমি শুনব না, কিচ্ছু শুনব না, দরজা বন্ধ করে থাকব।

 দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি, থাকো তাড়াতাড়ি আসছে; সে হাঁপিয়ে বললে, ছােটোরানীমা!— আমি বলে উঠলুম, যা যা, বিরক্ত করিস নে, আমার এখন সময় নেই।— থাকো বললে, মেজোরানীমার বােনপাে নন্দবাবু কলকাতা থেকে এক কল এনেচেন, সে মানুষের মতাে গান করে, তাই মেজোরানীমা তােমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।— হাসব কি কাঁদব তাই ভাবি। এর মাঝখানেও গ্রামােফোন! তাতে যতবার দম দিচ্ছে সেই থিয়েটারের নাকি সুর বেরােচ্ছে— ওর কোনাে ভাবনা নেই। যন্ত্র যখন জীবনের নকল করে তখন তা এমনি বিষম বিদ্রূপ হয়েই ওঠে।

 সন্ধ্যা হয়ে গেল। জানি, অমূল্য এলেই আমাকে খবর পাঠাতে দেরি করবে না, তবু থাকতে পারলুম না; বেহারাকে ডেকে বললুম, অমূল্যবাবুকে খবর দাও। বেহারা খানিকটা ঘুরে এসে বললে, অমূল্যবাবু নেই।

 কথাটা কিছুই নয়, কিন্তু হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে যেন তােলপাড় করে উঠল। ‘অমূল্যবাবু নেই’ সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে এ কথাটা যেন কান্নার মতাে বাজল। নেই, সে নেই! সে সূর্যাস্তের সােনার রেখাটির মতাে দেখা দিলে, তার পরে আর সে নেই! সম্ভব-অসম্ভব কত দুর্ঘটনার কল্পনাই আমার মাথার মধ্যে জমে উঠতে লাগল। আমিই তাকে মৃত্যুর মধ্যে পাঠিয়েছি। সে যে কোনাে ভয় করে নি সে তারই মহত্ত্ব, কিন্তু এর পরে আমি বেঁচে থাকব কেমন করে!

 অমূল্যর কোনাে চিহ্নই আমার কাছে ছিল না, কেবল ছিল তার সেই ভাইফোঁটার প্রণামী, সেই পিস্তলটি। মনে হল, এর মধ্যে দৈবের ইঙ্গিত রয়েছে। আমার জীবনের মূলে যে কলঙ্ক লেগেছে বালকবেশে আমার নারায়ণ