পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৪
ঘরে-বাইরে

শাখা-প্রশাখা এই বৃহৎ বাড়ির সমস্ত ঘরে আঙিনায় বারান্দায় ছাদে বাগানে তার ছায়া ছড়িয়ে দিয়ে তার সমস্তকে অধিকার করে দাঁড়িয়েছে। যখন দেখলুম, মেজোরানী তাঁর সমস্ত ছোটোখাটো জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্স বোঝাই করে আমাদের বাড়ির থেকে যাবার মুখ করে দাঁড়িয়েছেন, তখন এই চিরসম্বন্ধটির সমস্ত শিকড়গুলি পর্যন্ত আমার হৃদয়ের মধ্যে যেন শিউরে উঠল। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, কেন মেজোরানী, যিনি ন বছর বয়স থেকে আর এ পর্যন্ত কখনো একদিনের জন্যেও এ বাড়ি ছেড়ে বাইরে কাটান নি, তিনি তাঁর সমস্ত অভ্যাসের বাঁধন কেটে ফেলে অপরিচিতের মধ্যে ভেসে চললেন। অথচ সেই আসল কারণটির কথা মুখ ফুটে বলতেই চান না, অন্য কত রকমের তুচ্ছ ছুতো তোলেন। এই ভাগ্যকর্তৃক বঞ্চিত পতিপুত্রহীনা নারী সংসারের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র সম্বন্ধকে নিজের হৃদয়ের সমস্ত সঞ্চিত অমৃত দিয়ে পালন করেছেন, তাঁর বেদনা যে কত গভীর সে আজ তাঁর এই ঘরময় ছড়াছড়ি বাক্সপুঁটুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে যত স্পষ্ট করে বুঝলুম এমন আর কোনোদিন বুঝি নি। আমি বুঝেছি, টাকাকড়ি, ঘর-দুয়ারের ভাগ নিয়ে, ছোটোখাটো সামান্য সাংসারিক খুঁটিনাটি নিয়ে বিমলের সঙ্গে, আমার সঙ্গে তাঁর যে বার বার ঝগড়া হয়ে গেছে তার কারণ বৈষয়িকতা নয়, তার কারণ তাঁর জীবনের এই একটিমাত্র সম্বন্ধে তাঁর দাবি তিনি প্রবল করতে পারেন নি— বিমল কোথা থেকে হঠাৎ মাঝখানে এসে একে ম্লান করে দিয়েছে— এইখানে তিনি নড়তে-চড়তে ঘা পেয়েছেন, অথচ তাঁর নালিশ করবার জোর ছিল না। বিমলও একরকম করে বুঝেছিল, আমার উপর মেজোরানীর দাবি কেবলমাত্র সামাজিকতার দাবি নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর; সেইজন্যে আমাদের এই আশৈশবের সম্পর্কটির ’পরে তার এতটা ঈর্ষা। আজ বুকের দরজাটার কাছে আমার হৃদয় ধক্ ধক্ করে ঘা দিতে লাগল। একটা তোরঙ্গের উপর বসে পড়লুম। বললুম, মেজোরানীদিদি, আমরা দুজনেই এই বাড়িতে যেদিন নতুন দেখা দিয়েছি সেইদিনের মধ্যে আর-একবার ফিরে যেতে বড়ো ইচ্ছে করে।

 মেজোরানী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, না ভাই, মেয়ে-জন্ম নিয়ে আর নয়। যা সয়েছি তা একটা-জন্মের উপর দিয়ে যাক, ফের আর কি সয়?

 আমি বলে উঠলুম, দুঃখের ভিতর দিয়ে যে মুক্তি আসে সেই মুক্তি দুঃখের চেয়ে বড়ো।

 তিনি বললেন, তা হতে পারে ঠাকুরপো, তোমরা পুরুষ-মানুষ, মুক্তি তোমাদের জন্যে। আমরা মেয়েরা বাঁধতে চাই, বাঁধা পড়তে চাই— আমাদের