পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
২০১

সব আমি চুরি করে লুকিয়ে রাখতুম। জানতুম সে টাকা পাঁচ ভূতে লুটে খাবে। ঠাকুরপাে, তােমারও প্রায় সেই দশা। কত খেয়ালেই যে টাকা ওড়াতে জান! তােমাদের টাকা যদি আমরা চুরি করি তবেই সে টাকা রক্ষা পাবে। এখন চলো, একটু শােবে চলো।

 মেজোরানী আমাকে শােবার ঘরে ধরে নিয়ে গেলেন, আমি কোথায় চলেছি আমার মনেও ছিল না। তিনি আমার বিছানার পাশে বসে প্রফুল্লমুখে বললেন, ওলাে ও ছুটু, একটা পান দে তাে ভাই! তােরা যে একেবারে বিবি হয়ে উঠলি! পান নেই ঘরে? নাহয় আমার ঘর থেকেই আনিয়ে দে-না।

 আমি বললুম, মেজোরানী, তােমার তাে এখনাে খাওয়া হয় নি?

 তিনি বললেন, কোন্ কালে।

 এটা একেবারে মিথ্যে কথা। তিনি আমার পাশে বসে যা-তা বকতে লাগলেন, কত রাজ্যের কত বাজে কথা। দাসী এসে দরজার বাইরে থেকে খবর দিলে, বিমলের ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। বিমল কোনাে সাড়া দিলে না। মেজোরানী বললেন, ও কী, এখনাে তাের খাওয়া হয় নি বুঝি? বেলা যে ঢের হল এই বলে জোর করে তাকে ধরে নিয়ে গেলেন।

 সেই ছ হাজার ডাকাতির সঙ্গে এই লােহার সিন্দুকের টাকা বের করে নেওয়ার যে যােগ আছে তা বুঝতে পারলুম। কী রকমের যোেগ সে কথা জানতেও ইচ্ছা করল না। কোনােদিন সে প্রশ্নও করব না।


বিধাতা আমাদের জীবনছবির দাগ একটু ঝাপসা করেই টেনে দেন। আমরা নিজের হাতে সেটাকে কিছু কিছু বদলে মুছে পুরিয়ে দিয়ে নিজের মনের মতাে একটা স্পষ্ট চেহারা ফুটিয়ে তুলব, এই তাঁর অভিপ্রায়। সৃষ্টিকর্তার ইশারা নিয়ে নিজের জীবনটাকে নিজে সৃষ্টি করে তুলব, একটা বড়াে আইডিয়াকে আমার সমস্তর মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করে দেখাব, এই বেদনা বরাবর আমার মনে আছে।

 এই সাধনাতে এতদিন কাটিয়েছি। প্রবৃত্তিকে কত বঞ্চিত করেছি, নিজেকে কত দমন করেছি, সেই অন্তরের ইতিহাস অন্তর্যামীই জানেন। শক্ত কথা এই যে, কারাে জীবন একলার জিনিস নয়; সৃষ্টি যে করবে সে নিজের চার দিককে নিয়ে যদি না সৃষ্টি করে তবে ব্যর্থ হবে। মনের মধ্যে তাই একান্ত একটা প্রয়াস ছিল যে বিমলকেও এই রচনার মধ্যে টানব। সমস্ত প্রাণ দিয়ে তাকে ভালাে যখন বাসি তখন কেন পারব না, এই ছিল আমার জোর।