পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০২
ঘরে-বাইরে

 এমন সময় স্পষ্ট দেখতে পেলুম, নিজের সঙ্গে সঙ্গে নিজের চার দিককে যারা সহজেই সৃষ্টি করতে পারে তারা এক জাতের মানুষ, আমি সে জাতের না। আমি মন্ত্র নিয়েছি, কাউকে মন্ত্র দিতে পারি নি। যাদের কাছে আপনাকে সম্পূর্ণ ঢেলে দিয়েছি তারা আমার আর-সবই নিয়েছে কেবল আমার এই অন্তরতম জিনিসটি ছাড়া। আমার পরীক্ষা কঠিন হল। সব চেয়ে যেখানে সহায় চাই সব চেয়ে সেখানেই একলা হলুম। এই পরীক্ষাতেও জিতব, এই আমার পণ রইল। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার দুর্গম পথ আমার একলারই পথ।

 আজ সন্দেহ হচ্ছে, আমার মধ্যে একটা অত্যাচার ছিল। বিমলের সঙ্গে আমার সম্বন্ধটিকে একটা সুকঠিন ভালাের ছাঁচে নিখুঁত করে ঢালাই করব, আমার ইচ্ছার ভিতরে এই একটা জবরদস্তি আছে। কিন্তু মানুষের জীবনটা তাে ছাঁচে ঢালবার নয়। আর, ভালােকে জড়বস্তু মনে করে গড়ে তুলতে গেলেই মরে গিয়ে সে তার ভয়ানক শােধ নেয়।

 এই জুলুমের জন্যেই আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তফাত হয়ে গেছি, তা জানতেই পারি নি। বিমল নিজে যা হতে পারত তা আমার চাপে উপরে ফুটে উঠতে পারে নি বলেই নীচের তল থেকে রুদ্ধ জীবনের ঘর্ষণে বাঁধ খইয়ে ফেলেছে। এই ছ হাজার টাকা আজ ওকে চুরি করে নিতে হয়েছে। আমার সঙ্গে ও স্পষ্ট ব্যবহার করতে পারে নি, কেননা, ও বুঝেছে এক জায়গায় আমি ওর থেকে প্রবলরূপে পৃথক। আমাদের মধ্যে একরােখা আইডিয়ার মানুষের সঙ্গে যারা মেলে তারা মেলে, যারা মেলে না তারা আমাদের ঠকায়। সরল মানুষকেও আমরা কপট করে তুলি। আমরা সহধর্মিণীকে গড়তে গিয়ে স্ত্রীকে বিকৃত করি।

 আবার কি সেই গােড়ায় ফেরা যায় না? তা হলে একবার সহজের রাস্তায় চলি। আমার পথের সঙ্গিনীকে এবার কোনাে আইডিয়ার শিকল দিয়ে বাঁধতে চাইব না। কেবল আমার ভালােবাসার বাঁশি বাজিয়ে বলব, তুমি আমাকে ভালােবাসাে, সেই ভালােবাসার আলােতে তুমি যা তারই পূর্ণ বিকাশ হােক, আমার ফরমাশ একেবারে চাপা পড়ুক; তােমার মধ্যে বিধাতার যে ইচ্ছা আছে তারই জয় হােক, আমার ইচ্ছা লজ্জিত হয়ে ফিরে যাক।

 কিন্তু আমাদের মধ্যেকার যে বিচ্ছেদটা ভিতরে ভিতরে জমছিল সেটা আজ এমনতরাে একটা ক্ষতর মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে যে আর কি তার উপর স্বভাবের শুশ্রূষা কাজ করতে পারবে? যে আব্‌রুর আড়ালে প্রকৃতি আপনার সংশােধনের কাজ নিঃশব্দে করে সেই আব্‌রু যে একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল! ক্ষতকে ঢাকা দিতে হয়। এই ক্ষতকে আমার ভালােবাসা