পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০৬
ঘরে-বাইরে

 আমার স্বামী চৌকি থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে বললেন, আর তাে বেশি সময় নেই, এখন কাজগুলাে সেরে নেওয়া যাক।

 এমন সময় চন্দ্রনাথবাবু ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে ক্ষণকালের জন্যে সংকুচিত হলেন; বললেন, মাপ কোরাে মা, খবর দিয়ে আসতে পারি নি। নিখিল, মুসলমানের দল খেপে উঠেছে। হরিশ কুণ্ডুর কাছারি লুঠ হয়ে গেছে। সেজন্যে ভয় ছিল না, কিন্তু মেয়েদের উপর তারা যে অত্যাচার আরম্ভ করেছে সে তাে প্রাণ থাকতে সহ্য করা যায় না।

 আমার স্বামী বললেন, আমি তবে চললুম।

 আমি তাঁর হাত ধরে বললুম, তুমি গিয়ে কী করতে পারবে! মাস্টারমশাই, আপনি ওঁকে বারণ করুন!

 চন্দ্রনাথবাবু বললেন, মা, বারণ করবার তাে সময় নয়।

 আমার স্বামী বললেন, কিচ্ছু ভেবাে না বিমল!

 জানলার কাছে গিয়ে দেখলুম, তিনি ঘােড়া ছুটিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। হাতে তাঁর কোনাে অস্ত্রও ছিল না।

 একটু পরেই মেজোরানী ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকেই বললেন, করলি কী ছুটু, কী সর্বনাশ করলি! ঠাকুরপােকে যেতে দিলি কেন!

 বেহারাকে বললেন, ডাক্ ডাক্, শিগগির দেওয়ানবাবুকে ডেকে আন্।

 দেওয়ানবাবুর সামনে মেজোরানী কোনােদিন বেরােন নি। সেদিন তাঁর লজ্জা ছিল না। বললেন, মহারাজকে ফিরিয়ে আনতে শিগগির সওয়ার পাঠাও।

 দেওয়ানবাবু বললেন, আমরা অনেক মানা করেছি, তিনি ফিরবেন না।

 মেজোরানী বললেন, তাঁকে বলে পাঠাও, মেজোরানীর ওলাউঠো হয়েছে, তাঁর মরণকাল আসন্ন।

 দেওয়ান চলে গেলে মেজোরানী আমাকে গাল দিতে লাগলেন, রাক্ষুসী! সর্বনাশী! নিজে মরলি নে, ঠাকুরপােকে মরতে পাঠালি!


দিনের আলাে শেষ হয়ে এল। জানলার সামনে পশ্চিম-দিগন্তে গােয়ালপাড়ার ফুটন্ত শজনে-গাছটার পিছনে সূর্য অস্ত গেল। সেই সূর্যাস্তের প্রত্যেক রেখাটি আজও আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। অস্তমান সূর্যকে কেন্দ্র করে একটা মেঘের ঘটা উত্তরে দক্ষিণে দুই ভাগে ছড়িয়ে পড়েছিল, একটা প্রকাণ্ড পাখির ডানা মেলার মতাে; তার আগুনের রঙের পালকগুলাে থাকে থাকে সাজানাে। মনে হতে লাগল, আজকের দিনটা যেন হুহু করে উড়ে চলেছে। রাত্রের সমুদ্র পার হবার জন্যে।