পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২
ঘরে-বাইরে

প্রথম বর্ষার গেরুয়া বন্যার ধারার মতাে, হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ল। লােকে লােকে ভরে গেল। সেই ভিড়ের মধ্য দিয়ে একটা বড়াে চৌকির উপর বসিয়ে দশ-বারােজন ছেলে সন্দীপবাবুকে কাঁধে করে নিয়ে এল। বন্দে মাতরম্‌! বন্দে মাতরম্! বন্দে মাতরম্‌! আকাশটা যেন ফেটে টুকরাে টুকরাে হয়ে ছিঁড়ে পড়বে মনে হল।

 সন্দীপবাবুর ফোটোগ্রাফ পূর্বেই দেখেছিলুম। তখন যে ঠিক ভালাে লেগেছিল তা বলতে পারি নে। কুশ্রী দেখতে নয়, এমন-কি, রীতিমত সুশ্রীই। তবু জানি নে কেন আমার মনে হয়েছিল, উজ্জ্বলতা আছে বটে, কিন্তু চেহারাটা অনেকখানি খাদে মিশিয়ে গড়া চোখে আর ঠোঁটে কী একটা আছে যেটা খাটি নয়। সেইজন্যেই আমার স্বামী যখন বিনা দ্বিধায় তাঁর সকল দাবি পূরণ করতেন আমার ভালাে লাগত না। অপব্যয় আমি সইতে পারতুম। কিন্তু আমার কেবলই মনে হত, বন্ধু হয়ে এ লােকটা আমার স্বামীকে ঠকাচ্ছে। কেননা, ভাবখানা তাে তপস্বীর মতাে নয়, গরিবের মতােও নয়, দিব্যি বাবুর মতাে। ভিতরে আরামের লােভ আছে, অথচ—— এইরকম নানা কথা আমার মনে উদয় হয়েছিল। আজ সেই-সব কথা মনে উঠছে—— কিন্তু, থাক্। কিন্তু সেদিন সন্দীপবাবু যখন বক্তৃতা দিতে লাগলেন আর এই বৃহৎ সভার হৃদয় দুলে দুলে ফুলে ফুলে উঠে কূল ছাপিয়ে ভেসে যাবার জো হল, তখন তাঁর সে এক আশ্চর্য মূর্তি দেখলুম। বিশেষত এক সময় সূর্য ক্রমে নেমে এসে ছাদের নীচে দিয়ে তাঁর মুখের উপর যখন হঠাৎ রৌদ্র ছড়িয়ে দিলে তখন মনে হল তিনি যে অমরলােকের মানুষ এই কথাটা দেবতা সেদিন সমস্ত নরনারীর সামনে প্রকাশ করে দিলেন। বক্তৃতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক কথায় যেন ঝড়ের দমকা হাওয়া। সাহসের অন্ত নেই। আমার চোখের সামনে যেটুকু চিকের আড়াল ছিল সে আমি সইতে পারছিলুম না। কখন নিজের অগােচরে চিক খানিকটা সরিয়ে ফেলে মুখ বের করে তার মুখের দিকে চেয়েছিলুম আমার মনে পড়ে না। সমস্ত সভায় এমন একটি লােক ছিল না আমার মুখ দেখবার যার একটু অবকাশ ছিল। কেবল এক সময় দেখলুম, কালপুরুষের নক্ষত্রের মতাে সন্দীপবাবুর উজ্জ্বল দুই চোখ আমার মুখের উপর এসে পড়ল। কিন্তু আমার হুঁশ ছিল না। আমি কি তখন রাজবাড়ির বউ? আমি তখন বাংলাদেশের সমস্ত নারীর একমাত্র প্রতিনিধি, আর তিনি বাংলাদেশের বীর। যেমন আকাশের সূর্যের আলাে তাঁর ঐ ললাটের উপর পড়েছে,