পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
২৩

তেমনি দেশের নারীচিত্তের অভিষেক যে চাই। নইলে তার রণযাত্রার মাঙ্গল্য পূর্ণ হবে কী করে?

 আমি স্পষ্টই অনুভব করতে পারলুম, আমার মুখের দিকে চাওয়ার পর থেকে তার ভাষার আগুন আরাে জ্বলে উঠল। ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবা তখন আর রাশ মানতে চাইল না—— বজ্রের উপর বজ্রের গর্জন, বিদ্যুতের উপর বিদ্যুতের চমকানি। আমার মন বললে, আমারই চোখের শিখায় এই আগুন ধরিয়ে দিলে আমরা কি কেবল লক্ষ্মী, আমরাই তাে ভারতী।

 সেদিন একটা অপূর্ব আনন্দ আর অহংকারের দীপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলুম। ভিতরে একটা আগুনের ঝড়ের বেগ আমাকে এক মুহূর্তে এক কেন্দ্র থেকে আর-এক কেন্দ্রে টেনে নিয়ে গেল। আমার ইচ্ছা করতে লাগল গ্রীসের বীরাঙ্গনার মতাে আমার চুল কেটে দিই ঐ বীরের হাতের ধনুকের ছিলা করবার জন্যে—— আমার এই আজানুলম্বিত চুল। যদি ভিতরকার চিত্তের সঙ্গে বাইরেকার গয়নার যোেগ থাকত তা হলে আমার কণ্ঠী, আমার গলার হার, আমার বাজুবন্ধ, উল্কাবৃষ্টির মতাে সেই সভায় ছুটে ছুটে খসে খসে পড়ে যেত। নিজের অত্যন্ত একটা ক্ষতি করতে পারলে তবেই যেন সেই আনন্দের উৎসাহবেগ সহ্য করা সম্ভব হতে পারত।

 সন্ধ্যাবেলায় আমার স্বামী যখন ঘরে এলেন, আমার ভয় হতে লাগল পাছে তিনি সেদিনকার বক্তৃতার দীপকরাগিণীর সঙ্গে তান না মিলিয়ে কোনাে কথা বলেন, পাছে তার সত্যপ্রিয়তার কোনাে জায়গায় ঘা লাগাতে তিনি একটুও অসম্মতি প্রকাশ করেন তা হলে সেদিন আমি তাঁকে স্পষ্ট অবজ্ঞা করতে পারতুম।

 কিন্তু তিনি আমাকে কোনাে কথাই বললেন না। সেটাও আমাকে ভালাে লাগল না। তাঁর উচিত ছিল বলা, আজ সন্দীপের কথা শুনে আমার চৈতন্য হল, এ-সব বিষয়ে আমার অনেক দিনের ভুল ভেঙে গেল। আমার কেমন মনে হল, তিনি কেবল জেদ করে চুপ করে আছেন, জোর করেই উৎসাহ প্রকাশ করছেন না।

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, সন্দীপবাবু আর কতদিন এখানে আছেন?

 স্বামী বললেন, তিনি কাল সকালেই রংপুরে রওনা হবেন।

 কাল সকালেই?

 হাঁ, সেখানে তার বক্তৃতার সময় স্থির হয়ে গেছে।

 আমি একটুক্ষণ চুপ করে রইলুম। তার পরে বললুম, কোনােমতে কালকের দিনটা থেকে গেলে হয় না?