পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
২৭

 কবে তাঁর কঠিন অজীর্ণরোগ হয়েছিল তার ইতিহাস এল। প্রায় সাত মাস ধরে তাঁর কিরকম অসহ্য ভোগ গিয়েছে তাও শুনলুম। অ্যালোপ্যাথ হোমিওপ্যাথ সকল রকমের চিকিৎসকের উপদ্রব পার হয়ে অবশেষে কবিরাজের চিকিৎসায় কিরকম অশ্চর্য ফল পেয়েছেন তার বর্ণনা সেরে হেসে তিনি বললেন, ভগবান আমার ব্যামোগুলোও এমনি করে গড়েছেন যে, স্বদেশী বড়িটুকু হাতে-হাতে না পেলে তারা বিদায় হতে চায় না।

 আমার স্বামী এতক্ষণ পরে বললেন, আর বিদেশী ওষুধের শিশিগুলোও যে এক দণ্ড তোমার আশ্রয় ছাড়তে চায় না—— তোমার বসবার ঘরের তিনটি শেলফ যে একেবারে——

 ওগুলো কী জান? প্যুনিটিভ পুলিসের মতো। প্রয়োজন আছে বলে যে এসেছে তা নয়, আধুনিক কালের শাসনে ওরা ঘাড়ের উপরে এসে পড়ে—— কেবল দণ্ডই দিতে হয়, গুঁতোও কম খাই নে।

 আমার স্বামী অত্যুক্তি সইতে পারেন না। কিন্তু অলংকারমাত্রেই যে অত্যুক্তি; সে তো বিধাতার তৈরি নয়, মানুষের বানাননা। আমি একবার আমার নিজের কোনো-একটা মিথ্যার জবাবদিহির ছলে আমার স্বামীকে বলেছিলুম, গাছপালা পশুপাখিরাই আগাগোড়া সত্য বলে, বেচারাদের মিথ্যা বলবার শক্তি নেই। পশুর চেয়ে মানুষের এইখানেই শ্রেষ্ঠতা, আবার পুরুষের চেয়ে মেয়েদের শ্রেষ্ঠতাও এইখানে—— মেয়েদের বিস্তর অলংকার সাজে এবং বিস্তর মিথ্যাও মানায়।

 ঘর থেকে বাইরে এসে দেখি, মেজো জা একটা জানলার খড়খড়ি একটুখানি ফাঁক করে ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, এখানে যে?

 তিনি ফিস ফিস করে উত্তর করলেন, আড়ি পাতছিলুম।

 যখন ফিরে এলুম সন্দীপবাবু করুণ স্বরে বললেন, আপনার আজ বোধ হয় কিছুই খাওয়া হল না।

 শুনে আমার ভারি লজ্জা হল। আমি একটু বেশি শীঘ্র ফিরে এসেছি। ভদ্ররকম খাওয়ার জন্য যতটা সময় দেওয়া উচিত ছিল তা দেওয়া হয় নি। আজকের আমার খাওয়ার মধ্যে না খাওয়ার অংশটাই যে বেশি, সময়ের অঙ্ক হিসাব করলে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু কেউ যে সেই হিসাব করছিল তা আমার মনেও হয় নি।

 সন্দীপবাবু বোধ হয় আমার লজ্জাটুকু দেখতে পেলেন, সেইটেই আরো লজ্জা। তিনি বললেন, বনের হরিণীর মতো আপনার তো পালাবার দিকেই