পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৪
ঘরে-বাইরে

বিমলের জীবনে আমি আকস্মিক মাত্র; বিমলের সমস্ত প্রকৃতি যার সঙ্গে সত্য মিলতে পারে সে হচ্ছে সন্দীপ। এইটুকু জানাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।

 কেননা, আজ আমার নিজের কাছেও নিজের বিনয় করবার দিন নেই। সন্দীপের মধ্যে অনেক গুণ আছে যা লােভনীয়, সেই গুণে আমাকেও এতদিন সে আকর্ষণ করে এসেছে। কিন্তু খুব কম করেও যদি বলি তবু এ কথা আজ নিজের কাছে বলতে হবে যে, মােটের উপর সে আমার চেয়ে বড়াে নয়। স্বয়ম্বরসভায় আজ আমার গলায় যদি মালা না পড়ে, যদি মালা সন্দীপই পায়, তবে এই উপেক্ষায় দেবতা তাঁরই বিচার করলেন যিনি মালা দিলেন—আমার নয়। আজ আমার এ কথা অহংকার করে বলা নয়। আজ নিজের মূল্যকে নিজের মধ্যে যদি একান্ত সত্য করে না জানি ও না স্বীকার করি, আজকেকার এই আঘাতকে যদি আমার এই মানবজন্মের চরম অপমান বলেই মেনে নিতে হয়, তা হলে আমি আবর্জনার মতাে সংসারের আঁস্তাকুড়ে গিয়ে পড়ব, আমার দ্বারা আর কোনাে কাজই হবে না।

 অতএব আজ সমস্ত অসহ্য দুঃখের ভিতর দিয়েও আমার মনের মধ্যে একটা মুক্তির আনন্দ জাগুক। চেনাশােনা হল— বাহিরকেও বুঝলুম, অন্তরকেও বুঝলুম। সমস্ত লাভ-লােকসান মিটিয়ে যা বাকি রইল তাই আমি। সে তাে পঙ্গু-আমি নয়, দরিদ্র-আমি নয়; সে অন্তঃপুরের রােগীর পথ্যে-মানুষকরা রােগা-আমি নয়; সে বিধাতার শক্ত-হাতের তৈরি আমি। যা তার হবার তা হয়ে গেছে, আর তার কিছুতে মার নেই।


এইমাত্র মাস্টারমশায় আমার কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে বললেন, নিখিল শুতে যাও, রাত একটা হয়ে গেছে।

 অনেক রাত্রে বিমল খুব গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে না পড়লে আমার পক্ষে শুতে যাওয়া ভারি কঠিন হয়। দিনের বেলা তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়, কথাবার্তাও চলে। কিন্তু বিছানার মধ্যে একলা রাতের নিস্তব্ধতায় তার সঙ্গে কী কথা বলব? আমার সমস্ত দেহমন লজ্জিত হয়ে ওঠে।

 আমি মাস্টারমশায়কে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি এখনাে ঘুমােন নি কেন?

 তিনি একটু হেসে বললেন, আমার এখন ঘুমােবার বয়স গেছে, এখন জেগে থাকবার বয়স।

 এই পর্যন্ত লেখা হয়ে শুতে যাব-যাব করছি এমন সময় আমার জানলার সামনে আকাশে শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ একটা জায়গায় ছিন্ন হয়ে গেল— আর তারই মধ্যে থেকে একটা বড়ো তারা জ্বল্‌জ্জ্বল্ করে উঠল। আমার মনে হল,