পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭০
ঘরে-বাইরে

কোনােমতে এলাে চুলটা পাকিয়ে জড়িয়ে নিয়ে ভাঁড়ারঘরটা গােছাবার কাজে লােকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তােলা গেল। দেখি ইতিমধ্যে ভাঁড়ারে চুরি অনেক হয়ে গেছে; তা নিয়ে কাউকে বকতে সাহস হল না, পাছে এ কথা কেউ মনে মনেও জবাব করে, ‘এতদিন তােমার চোখ দুটো ছিল কোথা।’

 সেদিন ভূতে পাওয়ার মতাে এইরকম গােলমাল করে কাটল। তার পরের দিনে বই পড়বার চেষ্টা করলুম। কী পড়লুম কিছুই মনে নেই, কিন্তু এক-একবার দেখি ভুলে অন্যমনস্ক হয়ে বই-হাতে ঘুরতে ঘুরতে অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার রাস্তার জানলার একটা খড়খড়ি খুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। সেইখান থেকে আঙিনার উত্তর দিকে আমাদের বাইরের এক সার ঘর দেখা যায়। তার মধ্যে একটা ঘর মনে হল আমার জীবনসমুদ্রের ওপারে চলে গিয়েছে। সেখানে আর খেয়া বইবে না। চেয়ে আছি তাে চেয়েই আছি। নিজেকে মনে হল, আমি যেন পরশুদিনকার আমি’র ভূতের মতাে— সেই-সব জায়গাতেই আছি তবুও নেই।

 এক সময়ে দেখতে পেলুম, সন্দীপ একখানা খবরের কাগজ হাতে করে ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলুম, তাঁর মুখের ভাবে বিষম চাঞ্চল্য। এক-একবার মনে হতে লাগল, যেন উঠোনটার উপর, বারান্দার রেলিংগুলাের উপর রেগে রেগে উঠছেন। খবরের কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন; যদি পারতেন তাে খানিকটা আকাশ যেন ছিঁড়ে ফেলে দিতেন। প্রতিজ্ঞা আর থাকে না। যেই আমি বৈঠকখানার দিকে যাব মনে করছি এমন সময় হঠাৎ দেখি পিছনে আমার মেজো জা দাঁড়িয়ে।

 ‘ওলাে, অবাক করলি যে?’ এই কথা বলেই তিনি চলে গেলেন। আমার বাইরে যাওয়া হল না।

 পরের দিন সকালে গােবিন্দর মা এসে বলল, ছােটোরানীমা, ভাঁড়ার দেবার বেলা হল।

 আমি বললুম, হরিমতিকে বের করে নিতে বল। এই বলে চাবির গােছা ফেলে দিয়ে জানলার কাছে বসে বিলিতি সেলাইয়ের কাজ করতে লাগলুম। এমন সময় বেহারা এসে একখানা চিঠি আমার হাতে দিয়ে বললে, সন্দীপবাবু দিলেন।— সাহসের আর অন্ত নেই! বেহারাটা কী মনে করলে? বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল। চিঠি খুলে দেখি, তাতে কোনাে সম্ভাষণ নেই, কেবল এই কটি কথা আছে: বিশেষ প্রয়ােজন। দেশের কাজ। সন্দীপ।

 রইল আমার সেলাই পড়ে। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটুখানি চুল ঠিক করে নিলুম। শাড়িটা যেমন ছিল তাই রইল, জ্যাকেট একটা বদল