পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৪
ঘরে-বাইরে

জিনিস? আজ আর লজ্জা করবেন না, লােকের কানাঘুষায় কান দেবেন না। আজ বিধিনিষেধে তুড়ি মেরে মুক্তির মাঝখানে ছুটে বেরিয়ে আসুন।

 এমনি করে সন্দীপবাবুর কথায় দেশের স্তবের সঙ্গে যখন আমার স্তব মিশিয়ে যায় তখন সংকোচের বাঁধন আর টেঁকে না, তখন রক্তের মধ্যে নাচন ধরে। যত দিন আর্ট আর বৈষ্ণবকবিতা আর স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ-নির্ণয় আর বাস্তব-অবাস্তবের বিচার চলছিল তত দিন আমার মন গ্লানিতে কালাে হয়ে উঠছিল। আজ সেই অঙ্গারের কালিমায় আবার আগুন ধরে উঠল; সেই দীপ্তিই আমার লজ্জা নিবারণ করলে। মনে হতে লাগল, আমি যে রমণী সেটা যেন আমার একটা অপরূপ দৈবী মহিমা।

 হায় রে, আমার সেই মহিমা আমার চুলের ভিতর দিয়ে এখনই কেন একটা প্রত্যক্ষ দীপ্তির মতাে বেরােয় না? আমার মুখ দিয়ে এমন কোনাে একটা কথা উঠছে না কেন যা মন্ত্রের মতাে এখনই সমস্ত দেশকে অগ্নিদীক্ষায় দীক্ষিত করে দেয়?

 এমন সময় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমার ঘরের ক্ষেমাদাসী এসে উপস্থিত। সে বলে, আমার মাইনে চুকিয়ে দাও, আমি চলে যাই, আমি সাত জন্মে এমন— হাউহাউ, হাউহাউ!

 কী? ব্যাপারটা কী?

 মেজোরানীমার দাসী থাকো অকারণে গায়ে পড়ে ক্ষেমার সঙ্গে ঝগড়া করেছে, তাকে যা মুখে আসে তাই বলে গাল দিয়েছে।

 আমি যত বলি ‘আচ্ছা, সে আমি বিচার করব’ কিছুতেই ক্ষেমার কান্না আর থামে না।

 সকালবেলায় দীপক রাগিণীর যে সুর এমন জমে উঠেছিল তার উপরে যেন বাসন-মাজার জল ঢেলে দিলে। মেয়েমানুষ যে পদ্মবনের পঙ্কজ তার তলাকার পঙ্ক ঘুলিয়ে উঠল। সেটাকে সন্দীপের কাছে তাড়াতাড়ি চাপা দেবার জন্যে আমাকে তখনই অন্তঃপুরে ছুটতে হল। দেখি, আমার মেজো জা সেই বারান্দায় বসে একমনে মাথা নিচু করে সুপুরি কাটছেন; মুখে একটু হাসি লেগে আছে, গুন্ গুন্ করে গান করছেন ‘রাই আমার চলে যেতে ঢলে পড়ে’— ইতিমধ্যে কোথাও যে কিছু অনর্থপাত হয়েছে তার কোনাে লক্ষণ তার কোনােখানেই নেই।

 আমি বললুম, মেজোরানী, তােমার থাকো ক্ষেমাকে এমন মিছিমিছি গাল দেয় কেন?

 তিনি ভুরু তুলে আশ্চর্য হয়ে বললেন, ওমা, সত্যি নাকি? মাগীকে