পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৬
ঘরে-বাইরে

মতাে সুস্থ হয়ে উঠে একেবারে ভুলে যাব? না, ঘাড়-মােড় ভেঙে এমন সর্বনাশের তলায় তলিয়ে যাব যেখান থেকে ইহজীবনে আমার আর উদ্ধার নেই? জীবনের সৌভাগ্যকে সরলভাবে গ্রহণ করতে পারলুম না, এমন করে ছারখার করে দিলুম কী করে!

 আমার এই শােবার ঘর, যে ঘরে আজ ন বৎসর আগে নতুন বউ হয়ে পা দিয়েছিলুম, সেই ঘরের সমস্ত দেয়াল ছাদ মেজে আজ আমার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে আছে। এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমার স্বামী কলকাতা থেকে ভারত-সাগরের কোন এক দ্বীপের অনেক দামী এই পরগাছাটি কিনে এনেছিলেন। এই-কটি মাত্র পাতা, কিন্তু তাতে লম্বা যে একটি ফুলের গুচ্ছ ফুটেছিল সে যেন সৌন্দর্যের কোন্ পেয়ালা একেবারে উপুড় করে ঢেলে দেওয়া; ইন্দ্রধনু যেন ঐ-কটি পাতার কোলে ফুল হয়ে জন্ম নিয়ে দোল খাচ্ছে। সেই ফুটন্ত পরগাছাটিকে আমরা দুজনে মিলে আমাদের শােবার ঘরের এই জানলার কাছে টাঙিয়ে রেখেছি। সেই একবার ফুল হয়েছিল, আর হয় নি। আশা আছে, আবার আর-এক দিন ফুল ফুটবে। আশ্চর্য এই যে, অভ্যাসমত আজও এই গাছে আমি রােজ জল দিচ্ছি। আশ্চর্য এই যে, সেই নারকেল-দড়ি দিয়ে পাকে পাকে আঁট করে বাঁধা এই পাতাকয়টির বাঁধন আলগা হল না তার পাতাগুলি আজও সবুজ আছে।

 আজ চার বৎসর হল, আমার স্বামীর একটি ছবি হাতির দাঁতের ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঐ কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিয়েছিলুম। ওর দিকে দৈবাৎ যখন আমার চোখ পড়ে আর চোখ তুলতে পারি নে। আজ দুদিন আগেও রােজ সকালে স্নানের পর ফুল তুলে ঐ ছবির সামনে রেখে প্রণাম করেছি। কত দিন এই নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আমার তর্ক হয়ে গেছে।

 একদিন তিনি বললেন, তুমি যে আমাকে আমার চেয়ে বড়াে করে তুলে পুজো কর, এতে আমার বড়াে লজ্জা বােধ হয়।

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেন তােমার লজ্জা?

 স্বামী বললেন, শুধু লজ্জা নয়, ঈর্ষা।

 আমি বললুম, শােনাে একবার কথা! তােমার আবার ঈর্ষা কাকে?

 স্বামী বললেন, ঐ মিথ্যে-আমিটাকে। এর থেকে বুঝতে পারি, এই সামান্য-আমাকে নিয়ে তােমার সন্তোষ নেই, তুমি এমন অসমান্য কাউকে চাও যে তােমার বুদ্ধিকে অভিভূত করে দেবে, তাই আর-একটা আমাকে তুমি মন দিয়ে গড়ে তােমার মন ভােলাচ্ছ।

 আমি বললুম, তােমার এই কথাগুলাে শুনলে আমার রাগ হয়।