পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮০
ঘরে-বাইরে

যখনই কোনাে জাত বা মানুষ অন্যায় করতে সক্ষম হয় তখনই পৃথিবীর ভাঙা কুলােয় তার গতি।

 কিন্তু তবু এ আমার আইডিয়া, এ পুরােপুরি আমি নয়। যতই অন্যায়ের বড়াই করিনা কেন, আইডিয়ার উড়ুনির মধ্যে ফুটো আছে, ফাঁক আছে, তার ভিতর থেকে একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ে সে নেহাত কাঁচা— অতি নরম। তার কারণ, আমার অধিকাংশ আমার পূর্বেই তৈরি হয়ে গেছে।

 আমার চেলাদের নিয়ে আমি মাঝে মাঝে নিষ্ঠুরের পরীক্ষা করি। একদিন বাগানে চড়িভাতি করতে গিয়েছিলাম। একটা ছাগল চরে বেড়াচ্ছিল; আমি সবাইকে বললুম, কে ওর পিছনের একখানা পা এই দা দিয়ে কেটে আনতে পারে? সকলেই যখন ইতস্তত করছিল, আমি নিজে গিয়ে কেটে নিয়ে এলুম। আমাদের দলের মধ্যে সকলের চেয়ে যে লােক নিষ্ঠুর সে এই দৃশ্য দেখে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল। আমার শান্ত অবিচলিত মুখ দেখে সকলেই নির্বিকার মহাপুরুষ বলে আমার পায়ের ধুলাে নিলে। অর্থাৎ, সেদিন সকলেই আমার আইডিয়ার বাষ্পমণ্ডলটাই দেখলে। কিন্তু যেখানে আমি নিজের দোষে না ভাগ্যদোষে, দুর্বল, সকরুণ— যেখানে ভিতরে ভিতরে বুক ফাটছিল, সেখানে আমাকে ঢাকা দেওয়াই ভালাে।

 বিমল-নিখিলকে নিয়ে আমার জীবনের এই-যে একটা অধ্যায় জমে উঠেছে। এর ভিতরেও অনেকটা কথা ঢাকা পড়ছে। ঢাকা পড়ত না যদি আমার মধ্যে আইডিয়ার কোনাে বালাই না থাকত। আমার আইডিয়া আমার জীবনটাকে নিয়ে আপনার মতলবে গড়ছে। কিন্তু সেই মতলবের বাইরেও অনেকখানি জীবন বাকি পড়ে থাকছে। সেইটের সঙ্গে আমার মতলবের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল থাকে না; এইজন্যে তাকে চেপেচুপে ঢেকেঢুকে রাখতে চাই, নইলে সমস্তটাকে সে মাটি করে দেয়।

 প্রাণ জিনিসটা অস্পষ্ট, সে যে কত বিরুদ্ধতার সমষ্টি তার ঠিক নেই। আমরা আইডিয়াওয়ালা মানুষ তাকে একটা বিশেষ ছাঁচে ঢেলে একটা কোনাে বিশেষ আকারে সুস্পষ্ট করে জানতে চাই। সেই জীবনের সুস্পষ্টতাই জীবনের সফলতা। দ্বিগ্বিজয়ী সেকন্দর থেকে শুরু করে আজকের দিনের আমেরিকার ক্রোড়পতি রক্‌ফেলার পর্যন্ত সকলেই নিজেকে তলােয়ারের কিংবা টাকার বিশেষ একটা ছাঁচে ঢেলে জমিয়ে দেখতে পেরেছে বলেই নিজেকে সফল করে জেনেছে।

 এইখানেই আমাদের নিখিলের সঙ্গে আমার তর্ক বাধে। আমিও বলি, আপনাকে জানাে। সেও বলে, আপনাকে জানাে। কিন্তু, সে যা বলে তাতে