পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৮৭

আপন ধুয়ােয় ফিরে আসতে হয়। জীবনে মিলনসংগীতের ধুয়ােই হচ্ছে এইখানে, এই খােলা প্রকৃতির মধ্যে। এই ছল্‌ছল্‌-করা জলের উপরে যেখানে ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’, যেখানে শ্যামল পৃথিবী মাথায় ছায়ার ঘােমটা টেনে নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নায় কূলে কূলে কান পেতে সারা রাত আড়ি পাতছে—সেইখানেই স্ত্রীপুরুষের প্রথম চার চক্ষের মিলন হয়েছিল, দেয়ালের মধ্যে নয়। তাই এখানে আমরা একবার করে সেই আদিযুগের প্রথম-মিলনের ধুয়াের মধ্যে ফিরে আসি, যে মিলন হচ্ছে হরপার্বতীর মিলন, কৈলাসে মানসসরােবরের পদ্মবনে। আমার বিবাহের পর দু বছর কলকাতায় পরীক্ষার হাঙ্গামে কেটেছে। তার পর আজ এই সাত বছর প্রতি ভাদ্র মাসের চাঁদ আমাদের সেই জলের বাসরঘরে বিকশিত কুমুদবনের ধারে তার নীরব শুভশঙ্খ বাজিয়ে এসেছে। জীবনের সেই এক সপ্তক এমনি করে কাটল। আজ দ্বিতীয় সপ্তক আরম্ভ হয়েছে।

 ভাদ্রের সেই শুক্লপক্ষ এসেছে সে কথা আমি তাে কিছুতেই বুঝতে পারছি নে, প্রথম তিন দিন তাে কেটে গেল; বিমলের মনে পড়েছে কি না জানি নে, কিন্তু মনে করিয়ে দিল না। সব একেবারে চুপ হয়ে গেল, গান থেমে গেছে।—

ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মাের!

 বিরহে যে মন্দির শূন্য হয় সে মন্দিরের শূন্যতার মধ্যেও বাঁশি বাজে। কিন্তু বিচ্ছেদে যে মন্দির শূন্য হয় সে মন্দির বড়াে নিস্তব্ধ, সেখানে কান্নার শব্দও বেসুরাে শােনায়!

 আজ আমার কান্না বেসুরাে লাগছে। এ কান্না আমার থামাতেই হবে। আমার এই কান্না দিয়ে বিমলকে আমি বন্দী করে রাখব, এমন কাপুরুষ যেন আমি না হই। ভালােবাসা যেখানে একেবারে মিথ্যা হয়ে গেছে সেখানে কান্না যেন সেই মিথ্যাকে বাঁধাতে না চায়! যতক্ষণ আমার বেদনা প্রকাশ পাবে ততক্ষণ বিমল একেবারে মুক্তি পাবে না।

 কিন্তু তাকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি দেব, নইলে মিথ্যার হাত থেকে আমিও মুক্তি পাব না। আজ তাকে আমার সঙ্গে বেঁধে রাখা নিজেকেই মায়ার জালে জড়িয়ে রাখা মাত্র। তাতে কারাে কিছুই মঙ্গল নেই, সুখ তাে নেইই। ছুটি দাও, ছুটি নাও। দুঃখ বুকের মানিক হবে যদি মিথ্যা থেকে খালাস পেতে পার।

 আমার মনে হচ্ছে, যেন এইবার আমি একটা জিনিস বুঝতে পারার কিনারায় এসেছি। স্ত্রীপুরুষের ভালােবাসাটাকে সকলে মিলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে