পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯২
ঘরে-বাইরে

দিতে হবে বলে। তাতে করে হয়েছে এই যে, তাকেই দিন-রাত সাজিয়েছি, পরিয়েছি, শিখিয়েছি, তাকেই চিরদিন প্রদক্ষিণ করেছি— মানুষ যে কত বড়াে, জীবন যে কত মহৎ, সে কথা স্পষ্ট করে মনে রাখতে পারি নি।

 তবু এর ভিতরেও আমাকে রক্ষা করেছেন আমার মাস্টারমশায়— তিনিই আমাকে যতটা পেরেছেন বড়াের দিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, নইলে আজকের দিনে আমি সর্বনাশের মধ্যে তলিয়ে যেতুম। আশ্চর্য ঐ মানুষটি। আমি ওঁকে আশ্চর্য বলছি এইজন্যে যে, আজকের আমার এই দেশের সঙ্গে কালের সঙ্গে ওঁর এমন একটা প্রবল পার্থক্য আছে! উনি আপনার অন্তর্যামীকে দেখতে পেয়েছেন, সেইজন্যে আর-কিছুতে ওঁকে ভােলাতে পারে না। আজ যখন আমার জীবনের দেনা-পাওনার হিসাব করি তখন এক দিকে একটা মস্ত ঠিক-ভুল, একটা বড়াে লােকসান ধরা পড়ে, কিন্তু লােকসান ছাড়িয়ে উঠতে পারে এমন একটি লাভের অঙ্ক আমার জীবনে আছে সে কথা যেন জোর করে বলতে পারি।

 আমাকে যখন উনি পড়ানাে শেষ করেছেন তার পূর্বেই পিতৃবিয়ােগ হয়ে আমি স্বাধীন হয়েছি। আমি মাস্টারমশায়কে বললুম, আপনি আমার কাছেই থাকুন, অন্য জায়গায় কাজ করবেন না।

 তিনি বললেন, দেখাে, তােমাকে আমি যা দিয়েছি তার দাম পেয়েছি। তার চেয়ে বেশি যা দিয়েছি তার দাম যদি নিই তা হলে আমার ভগবানকে হাটে বিক্রি করা হবে।

 বরাবর তাঁর বাসা থেকে রৌদ্রবৃষ্টি মাথায় করে চন্দ্রনাথবাবু আমাকে পড়াতে এসেছেন, কোনমতেই আমাদের গাড়ি-ঘােড়া তাঁকে ব্যবহার করাতে পারলুম না। তিনি বলতেন, আমার বাবা চিরকাল বটতলা থেকে লালদিঘি পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে আপিস করে আমাদের মানুষ করেছেন, শেয়ারের গাড়িতেও কখনাে চাপেন নি, আমরা হচ্ছি পুরুষানুক্রমে পদাতিক।

 আমি বললুম, না-হয় আমাদের বিষয়কর্মসংক্রান্ত একটা কাজ নিন।

 তিনি বললেন, না বাবা, আমাকে তােমাদের বড়ােমানুষির ফাঁদে ফেলাে না, আমি মুক্ত থাকতে চাই।

 তাঁর ছেলে এখন এম. এ. পাস করে চাকরি খুঁজছে। আমি বললুম, আমার এখানে তার একটা কাজ হতে পারে। ছেলেরও সেই ইচ্ছে খুব ছিল। প্রথমে সে তার বাবাকে এই কথা জানিয়েছিল, সেখানে সুবিধে পায় নি। তখন লুকিয়ে আমাকে আভাস দেয়। তখনই আমি উৎসাহ করে চন্দ্রনাথবাবুকে বললুম। তিনি বললেন, না, এখানে তার কাজ হবে না।— তাকে এত বড়াে