পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৯৫

 আমার স্বামী যে অবিচলিত ছিলেন তা নয়। কিন্তু সমস্ত উত্তেজনার মধ্যে তাঁকে যেন একটা বিষাদ এসে আঘাত করত। যেটা সামনে দেখা যাচ্ছে তার উপর দিয়েও তিনি যেন আর-একটা-কিছুকে দেখতে পেতেন। মনে আছে সন্দীপের সঙ্গে তর্কে তিনি একদিন বলেছিলেন, সৌভাগ্য হঠাৎ এসে আমাদের দরজার কাছে হাঁক দিয়ে যায় কেবল দেখাবার জন্যে যে তাকে গ্রহণ করবার শক্তি আমাদের নেই, তাকে ঘরের মধ্যে নিমন্ত্রণ করে বসাবার কোনাে আয়ােজন আমরা করি নি।

 সন্দীপ বললেন, দেখাে নিখিল, তুমি দেবতাকে মানো না, সেইজন্যেই এমন নাস্তিকের মতাে কথা কও। আমরা প্রত্যক্ষ দেখছি দেবী বর দিতে এসেছেন। আর, তুমি অবিশ্বাস করছ!

 আমার স্বামী বললেন, আমি দেবতাকে মানি, সেইজন্যেই অন্তরের মধ্যে নিশ্চিত জানি তাঁর পূজা আমরা জোটাতে পারলুম না। বর দেবার শক্তি দেবতার আছে, কিন্তু বর নেবার শক্তি আমাদের থাকা চাই।

 আমার স্বামীর এইরকমের কথায় আমার ভারি রাগ হত। আমি তাঁকে বললুম, তুমি মনে কর দেশের এই উদ্দীপনা, এ কেবলমাত্র একটা নেশা। কিন্তু নেশায় কি শক্তি দেয় না?

 তিনি বললেন, শক্তি দেয়, কিন্তু অস্ত্র দেয় না।

 আমি বললুম, শক্তি দেবতা দেন, সেইটেই দুর্লভ। আর, অস্ত্র তাে সামান্য কামারেও দিতে পারে।

 স্বামী হেসে বললেন, কামার তাে অমনি দেয় না, তাকে দাম দিতে হয়।

 সন্দীপ বুক ফুলিয়ে বললেন, দাম দেব গাে দেব।

 স্বামী বললেন, যখন দেবে তখন আমি উৎসবের রােশনচৌকি বায়না দেব।

 সন্দীপ বললেন, তােমার বায়নার আশায় আমরা বসে নেই। আমাদের নিকড়িয়া উৎসব কড়ি দিয়ে কিনতে হবে না।

 ব’লে তিনি তাঁর ভাঙা মােটা গলায় গান ধরলেন—

আমার  নিকড়িয়া রসের রসিক কানন ঘুরে ঘুরে
নিকড়িয়া বাঁশের বাঁশি বাজায় মােহন সুরে।

আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, মক্ষীরানী, গান যখন প্রাণে আসে তখন গলা না থাকলেও যে বাঁধে না এইটে প্রমাণ করে দেবার জন্যেই গাইলুম। গলার জোরে গাইলে গানের জোর হালকা হয়ে যায়। আমাদের দেশে হঠাৎ ভরপুর গান এসে পড়েছে, এখন নিখিল বসে বসে গােড়া থেকে সারগম সাধতে থাকুক, ইতিমধ্যে আমরা ভাঙা গলায় মাতিয়ে তুলব।