পাতা:চারিত্রপূজা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিদ্যাসাগর-চরিত
৫৯

মধ্য দিয়া চলিতে পারেন নাই; তাঁহারও স্নেহ ভক্তি দয়া, তাঁহার বিপুল বিস্তীর্ণ হৃদয়, সমস্ত আদব-কায়দাকে বিদীর্ণ করিয়া কেমন অসামান্য আকারে ব্যক্ত হইত তাহা তাঁহার জীবনচরিতে নানা ঘটনায় প্রকাশ পাইয়াছে।

 এইখানে জন‍্সন্ সম্বন্ধে কার্লাইল যাহা লিখিয়াছেন তাহার কিয়দংশ অনুবাদ করি।—

 তিনি বলিষ্ঠচেতা এবং মহৎ-লোক ছিলেন। শেষ পর্যন্তই অনেক জিনিস তাঁহার মধ্যে অপরিণত থাকিয়া গিয়াছিল। অনুকূল উপকরণের মধ্যে তিনি কী না হইতে পারিতেন— কবি, ঋষি, রাজাধিরাজ। কিন্তু মোটের উপরে, নিজের ‘উপকরণ' নিজের ‘কাল’ এবং ঐগুলা লইয়া নালিশ করিবার প্রয়োজন কোনো লোকেরই নাই, উহা একটা নিষ্ফল আক্ষেপমাত্র। তাঁহার কালটা খারাপ ছিল, ভালোই, তিনি সেটাকে আরো ভালো করিবার জন্যই আসিয়াছেন। জন‍্সনের কৈশোরকাল ধনহীন, সঙ্গহীন, আশাহীন এবং দুর্ভাগ্যজালে বিজড়িত ছিল। তা থাক্‌, কিন্তু বাহ্য অবস্থা অনুকূলতম হইলেও জন‍্সনের জীবন দুঃখের জীবন হওয়া ছাড়া আর কিছু হওয়া সম্ভবপর হইত না। প্রকৃতি তাঁহার মহত্ত্বের প্রতিদানস্বরূপ তাঁহাকে বলিয়াছিল, রোগাতুর দুঃখরাশির মধ্যে বাস করে। না, বোধ করি, দুঃখ এবং মহত্ব ঘনিষ্ঠভাবে, এমন-কি, অচ্ছেদ্যভাবে পরস্পর জড়িত ছিল। যে কারণেই হউক, অভাগা জন‍্সনকে নিয়তই রোগাবিষ্টতা, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বেদনা, কোমরে বঁধিয়া ফিরিতে হইত। তাঁহাকে একবার কল্পনা করিয়া দেখে, তাঁহার সেই রুগ‍্ণশরীর, তাঁহার ক্ষুধিত প্রকাণ্ড হৃদয় এবং অনির্বচনীয় উদ‍্বর্তিত চিন্তাপুঞ্জ লইয়া পৃথিবীতে বিপাদাকীর্ণ বিদেশীর মতো ফিরিতেছেন, ব্যগ্রভাবে গ্রাস করিতেছেন যে-কোনো পারমার্থিক পদার্থ সম্মুখে আসিয়া পড়ে, আর যদি কিছুই না পান তবে অন্তত বিদ্যালয়ের ভাষা এবং কেবলমাত্র ব্যাকরণের ব্যাপার। সমস্ত ইংলণ্ডের মধ্যে বিপুলতম অন্তঃকরণ যাহা ছিল তাঁহারই ছিল, অথচ তাঁহার জন্য বরাদ্দ ছিল সাড়ে চার আনা করিয়া প্রতিদিন। তবু সে হৃদয় ছিল অপরাজিত মহাবলী, প্রকৃত মনুষের হৃদয়। অক‍্স‍্ফোর্ডে তাঁহার সেই জুতাজোড়ার গল্পটা সবাই মনে পড়ে। মনে পড়ে, কেমন করিয়া সেই, দাগ-কাটা মুখ, হাড়-বাহির-করা, কলেজের দীন ছাত্র শীতের সময় জীর্ণ জুতা লইয়া যুরিয়া বেড়াইতেছে; কেমন করিয়া এক কৃপালু সচ্ছল ছাত্র গোপনে একজোড়া জুতা