পাতা:চিঠিপত্র (অষ্টাদশ খণ্ড)-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমুদ্রের এপারে ওপারে পাড়ি দিলুম— এখন এসে দেখি সে নদী যেন আমাকে চেনে না; ছাদের উপরে দাড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে দেখি, মাঝখানে কত মাঠ, কত গ্রামের আড়াল,— সবশেষে উত্তর দিগন্তে আকাশের নীলাঞ্চলের একটি নীলতর পাড়ের মত একটি বনরেখা দেখা যায়, সেই নীল রেখাটির কাছে ঐ যে একটি ঝাপসা বাষ্পলেখাটির মত দেখতে পাচ্চি জানি ঐ আমার সেই পদ্মা, আজ আমার কাছে অনুমানের বিষয় হয়ে রয়েচে। এই ত মানুষের জীবন, ক্রমাগতই কাছের জিনিষ দূরে চলে যায়, জানা জিনিষ ঝাপসা হয়ে আসে, আর যে স্রোত বন্যার মত প্রাণমনকে প্লাবিত করেচে, সেই স্রোত একদিন অশ্রুবাম্পের একটি রেখার মত জীবনের একাস্তে অবশিষ্ট থাকে। এখন বেলা ফুরিয়ে এসেচে, ছটা বাজল। অল্প একটুখানি মেঘেতে আকাশ ঢাকা। দিনাবসানেও বাগানে পাখীর ডাকে একটুও ক্লাস্তি দেখচিনে। দুই কোকিলে কেবলি জবাব চলচে, কেউ হার মানতে চাচ্চে না— তা ছাড়া আরো অনেক পাখী ডাক্‌চে তাদের ডাক স্পষ্ট করে চেনা যায় না, সকলের ডাক মিশিয়ে জড়িয়ে গেছে। অন্যদিনের মত বাতাস আজ দুরন্ত নয়, ঝাউগাছগুলি স্তব্ধ এবং নিঃশব্দ হয়ে গেছে। আজ অষ্টমীর চাদ দেখচি মেঘের পদার আড়ালে রাত্রি যাপন করবে। আমার ঘরের দক্ষিণ দিকে ঐ ছাদে একটি কেদারা পাতা আছে— ঐখানে সন্ধ্যার সময় আমি গিয়ে বসি— এ কয়দিন দ্বিতীয়ার চাদ থেকে আরম্ভ করে অষ্টমীর চাদ পর্যন্ত প্রত্যেকেই উদয়কালে এই কবির সঙ্গে মুকাবিলা করেচে। ঐ চাদ হচ্চে আমার জন্মলগ্নের অধিপতি, আর আমার কাব্য প্রভৃতি স্থানের অধিপতি হচ্চে বৃহস্পতি। আমি যখন ছাদে বসি তখন আমার বামে পূৰ্ব্ব আকাশ থেকে বৃহস্পতি আমার মুখের দিকে তাকায় আর পশ্চিম আকাশ থেকে চন্দ্রমা – এইবার ক্রমে একটু অন্ধকার হয়ে আসচে— ঘরের মধ্যেকার এই ঘোলা আলোয় আর দৃষ্টি চলচেনা; বাইরে গিয়ে বসবার সময় হল।