পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৬
চোখের বালি

সে আসিবে। বিহারীকে নিজের দলে পাইয়া তাহার প্রতি রাজলক্ষ্মীর সমবেদনা বাড়িয়া উঠিল। বিহারী যে ছেলেবেলা হইতে একান্ত নিঃস্বার্থভাবে মহেন্দ্রের কত উপকার করিয়াছে, তাহার জন্য কতবার কত কষ্ট সহ্য করিয়াছে, সে-সমস্ত তিনি বিনোদিনীর কাছে বিবৃত করিয়া বলিতে লাগিলেন— ছেলের উপর তাঁহার নিজের যা নালিশ তা বিহারীর বিবরণ দ্বারা সমর্থন করিতে লাগিলেন। দুদিন বউকে পাইয়া মহেন্দ্র যদি তাহার চিরকালের বন্ধুকে এমন অনাদর করে, তবে সংসারে ন্যায়ধর্ম আর রহিল কোথায়।

 বিনোদিনী কহিল, “কাল রবিবার আছে, তুমি বিহারী-ঠাকুরপোকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াও, তিনি খুশি হইবেন।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছ বউ, তা হইলে মহিনকে ডাকাই, সে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইবে।”

 বিনোদিনী। না পিসিমা, তুমি নিজে নিমন্ত্রণ করো।

 রাজলক্ষ্মী। আমি কি তোমাদের মতো লিখিতে পড়িতে জানি।

 বিনোদিনী। তা হোক, তোমার হইয়া নাহয় আমিই লিখিয়া দিতেছি।

 বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর নাম দিয়া নিজেই নিমন্ত্রণ-চিঠি লিখিয়া পাঠাইল।

 রবিবার দিন মহেন্দ্রের অত্যন্ত আগ্রহের দিন। পূর্বরাত্রি হইতেই তাহার কল্পনা উদ্দাম হইয়া উঠিতে থাকে, যদিও এ পর্যন্ত তাহার কল্পনার অম্বরূপ কিছুই হয় নাই— তবু রবিবারের ভোরের আলো তাহার চক্ষে মধুবর্ষণ করিতে লাগিল। জাগ্রত নগরীর সমস্ত কোলাহল তাহার কানে অপরূপ সংগীতের মতো আসিয়া প্রবেশ করিল।

 কিন্তু ব্যাপারখানা কী। মার আজ কোনো ব্রত আছে নাকি। অন্য দিনের মতো বিনোদিনীর প্রতি গৃহকর্মের ভার দিয়া তিনি তো বিশ্রাম করিতেছেন না। আজ তিনি নিজেই ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছেন।

 এই হাঙ্গামে দশটা বাজিয়া গেল— ইতিমধ্যে মহেন্দ্র কোনো ছুতায় বিনোদিনীর সঙ্গে এক মুহূর্ত বিরলে দেখা করিতে পারিল না। বই পড়িতে চেষ্টা করিল, পড়ায় কিছুতেই মন বসিল না; খবরের কাগজের একটা অনাবশ্যত বিজ্ঞাপনে পনেরো মিনিট দৃষ্টি আবদ্ধ হইয়া রহিল। আর থাকিতে পারিল না। নীচে গিয়া দেখিল, মা তাঁহার ঘরের বারান্দায় একটা তোলা উনানে রাঁধিতেছেন এবং বিনোদিনী কটিদেশে দৃঢ় করিয়া আঁচল জড়াইয়া জোগান দিতে ব্যস্ত।

 মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “আজ তোমাদের ব্যাপারটা কী। এত ধুমধাম যে?”