১৩০
চোখের বালি
তো বিবেচনা নাই— কাজ থাক্ কর্ম থাক্, ইচ্ছা থাক্ বা না থাক্, তবু বসিতেই হইবে। এত অধিক আদরের আমি তো কোনো মানে বুঝিতে পারি না।”
বিনোদিনী উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, শোনো একবার, তোমার মহিনদার কথা শোনো। আদরের মানে আদর, অভিধানে তাহার আর কোনো দ্বিতীয় মানে লেখে না।”—
মহেন্দ্রের প্রতি, “যাই বল ঠাকুরপো, অধিক আদরের মানে শিশুকাল হইতে তুমি যত পরিষ্কার বোঝ, এমন আর কেহ বোঝে না।”
বিহারী কহিল, “মহিনদা, একটা কথা আছে, একবার শুনিয়া যাও।”
বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে কোনো বিদায়সস্তাবণ না করিয়া মহেন্দ্রকে লইয়া বাহিরে গেল। বিনোদিনী বারান্দার রেলিং ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া শূন্য উঠানের শূন্যতার দিকে তাকাইয়া রহিল।
বিহারী বাহিরে আসিয়া কহিল, “মহিনদা, আমি জানিতে চাই, এইখানেই কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হইল।”
মহেন্দ্রের বুকের ভিতর তখন জ্বলিতেছিল, বিনোদিনীর পরিহাস-হাস্য বিদ্যুৎশিখার মতো তাহার মস্তিষ্কের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া বিঁধিতেছিল; সে কহিল, “মিটমাট হইলে তোমার তাহাতে বিশেষ সুবিধা হইতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তাহা প্রার্থনীয় বোধ হয় না। আমার সংসারের মধ্যে আমি বাহিরের লোক ঢুকাইতে চাই না, অন্তঃপুরকে আমি অন্তঃপুর রাখিতে চাই।”
বিহারী কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। ঈর্ষাজর্জর মহেন্দ্র একবার প্রতিজ্ঞা করিল, ‘বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা করিব না। তাহার পরে বিনোদিনীর সহিত সাক্ষাতের প্রত্যাশায় ঘরে বাহিরে, উপরে নীচে ছট্ফট্ করিয়া বেড়াইতে লাগিল।
আশা একদিন অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা মাসিমা, মেসোমশায়কে তোমার মনে পড়ে?”
অন্নপূর্ণ কছিলেন, “আমি এগারো বৎসর বয়সে বিধবা হইয়াছি, স্বামীর মূর্তি ছায়ার মতো মনে হয়।”
আশা জিজ্ঞাসা করিল, “মাসি, তবে তুমি কাহার কথা ভাব।”