আশা যথাসাধ্য নিঃশব্দে সংকুচিত হইয়া খাটের উপর গিয়া উঠিল। তবু তাহাতে এতটুকু শব্দ ও নড়াচড়া হইল যে, মহেন্দ্র যদি সত্যই ঘুমাইত তাহা হইলে জাগিয়া উঠিত। কিন্তু আজ তাহার চক্ষু খুলিল না; কেননা, মহেন্দ্র ঘুমাইতেছিল। মহেন্দ্র খাটের অপর প্রান্তে পাশ ফিরিয়া শুইয়া ছিল, সুতরাং আশা তাহার পশ্চাতে শুইয়া রহিল। আশা যে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করিতেছিল, তাহা পিছন ফিরিয়া ও মহেন্দ্র স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছিল। নিজের নিষ্ঠুরতায় তাহার হৃৎপিণ্ডটাকে যেন জাঁতার মতাে পেষণ করিয়া ব্যথা দিতেছিল। কিন্তু কী কথা বলিবে, কেমন করিয়া আদর করিবে, মহেন্দ্র তাহা কোনােমতেই ভাবিয়া পাইল না; মনে মনে নিজেকে সুতীব্র কশাঘাত করিতে লাগিল, তাহাতে আঘাত পাইল, কিন্তু উপায় পাইল না! ভাবিল, ‘প্রাতঃকালে তত ঘুমের ভান করা যাইবে না, তখন মূখোমূখি হইলে আশাকে কী কথা বলিব।’
আশা নিজেই মহেন্দ্রের সে সংকট করিয়া দিল। সে অতি প্রত্যুষেই অপমানিত সাজসজ্জা লইয়া বিছানা ছাড়িয়া চলিয়া গেল, সেও মহেন্দ্রকে মুখ দেখাইতে পারিল না।
আশা ভাবিতে লাগিল, ‘এমন কেন হইল। আমি কী করিয়াছি।’ যে জায়গায় যথার্থ বিপদ সে জায়গায় তাহার চোখ পড়িল না। বিনােদিনীকে যে মহেন্দ্র ভালােবাসতে পারে, এ সম্ভাবনাও তাহার মনে উদয় হয় নাই। সংসারের অভিজ্ঞতা তাহার কিছুই ছিল না। তা ছাড়া বিবাহের অনতিকাল পর হইতেই সে মহেন্দ্রকে যাহা বলিয়া নিশ্চয় জানিয়াছিল, মহেন্দ্র যে তাহা ছাড়া আর-কিছুই হইতে পারে, ইহা তাহার কল্পনাতেও আসে নাই।
মহেন্দ্র আজ সকাল-সকাল কলেজে গেল। কলেজ-যাত্রা-কালে আশা বরাবর জানলার কাছে আসিয়া দাঁড়াইত, এবং মহেন্দ্র গাড়ি হইতে একবার মুখ তুলিয়া দেখিত, ইহা তাহাদের চিরকালের নিত্যপ্রথা ছিল। সেই অভ্যাস অনুসারে গাড়ির শব্দ শুনিবা মাত্র যন্ত্রচালিতের মতাে আশা জানালার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। মহেন্দ্রও অভ্যাসের খাতিরে একবার চকিতের মতাে উপরে চোখ তুলিল; দেখিল, আশা দাঁড়াইয়া আছে– তখনাে তাহার মান হয় নাই, মলিন বস্ত্র, অসংযত কেশ, শুষ্ক মুখ– দেখিয়া নিমেষের মধ্যেই মহেন্দ্র চোখ নামইয়া কোলের বই