পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৩৯

 ঘড়িতে যখন একটা বাজিল, তখন মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না, মশারি খুলিয়া বাহির হইয়া পড়িল। ছাদে আসিয়া দেখিল, গ্রীষ্মের জ্যোৎস্নারাত্রি বড়ো রমণীয় হইয়াছে। কলিকাতার প্রকাণ্ড নিঃশব্দতা এবং সুপ্তি যেন স্তব্ধ সমুদ্রের জলরাশির ন্যায় স্পর্শগম্য বলিয়া বোধ হইতেছে; অসংখ্য হর্ম্যশ্রেণীর উপর দিয়া মহানগরীর নিদ্রাকে নিবিড়তর করিয়া বাতাস মৃগমনে পদচারণ করিয়া আসিতেছে।

 মহেন্দ্রের বহু দিনের রুদ্ধ আকাঙ্ক্ষা আপনাকে আর ধরিয়া রাখিতে পারিল না। আশা কাশী হইতে ফিরিয়া অবধি, বিনোদিনী তাহাকে দেখা দেয় নাই। জ্যোৎস্নামদবিহ্বল নির্জন রাত্রি মহেন্দ্রকে মোহাবিষ্ট করিয়া বিনোদিনীর দিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। মহেন্দ্র সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল। বিনোদিনীর ঘরের সম্মুখের বারান্দায় আসিয়া দেখিল, ঘর বন্ধ নাই। ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, বিছানা তৈরি রহিয়াছে, কেহ শোয় নাই। ঘরের মধ্যে পদশব্দ শুনিতে পাইয়া ঘরের দক্ষিণ দিকের খোলা বারান্দা হইতে বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, “কে ও।”

 মহেন্দ্র অভিভূত আর্দ্র কণ্ঠে উত্তর করিল, “বিনোদ, আমি।”

 বলিয়া সে একেবারে বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইল।

 গ্রীষ্মরাত্রিতে বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বিনোদিনীর সঙ্গে রাজলক্ষ্মী শুইয়া ছিলেন। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “মহিন, এত রাত্রে তুই এখানে যে।”

 বিনোদিনী তাহার ঘনকৃষ্ণ ভ্রূযুগের নীচে হইতে মহেন্দ্রের প্রতি বজ্রাগ্নি নিক্ষেপ করিল। মহেন্দ্র কোন উত্তর না দিয়া দ্রুতপদে সেখান হইতে চলিয়া গেল।


৩৩

পরদিন প্রত্যুষ হইতে ঘনঘটা করিয়া আছে। কিছুকাল অসহ্য উত্তাপের পর স্নিগ্ধশ্যামল মেঘে দগ্ধ আকাশ জুড়াইয়া গেল। আজ মহেন্দ্র সময় হইবার পূর্বেই কলেজে গেছে। তাহার ছাড়া কাপড়গুলা মেঝের উপর পড়ি। আশা মহেন্দ্রের ময়লা কাপড় গনিয়া গনিয়া, তাহার হিসাব রাখিয়া খোবাকে বুঝাইয়া দিতেছে।

 মহেন্দ্র স্বভাবত ভোলামন অসাবধান লোক; এইজন্য আশার প্রতি তাহার অনুবরোধ ছিল ধোবার বাড়ি দিবার পূর্বে তাহার ছাড়া কাপড়ের পকেট তদন্ত করিয়া লওয়া হয় যেন। মহেন্দ্রের একটা ছাড়া জামার পকেটে হাত দিতেই একখানা চিঠি আশার হাতে ঠেকিল।