পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৪১

সাড়া পাইবে না। চিঠিতে তুমি আমাকে নিষ্ঠুর বলিয়াছ; সে যথা সত্য হইতে পারে; কিন্তু আমার কিছু দয়াও আছে, তাই আজ তোমাকে আমি দয়া করিয়া ত্যাগ করিলাম। এ চিঠির যদি উত্তর দাও তবে বুঝিব, না পালাইলে তোমার হাত হইতে আমার আর নিষ্কৃতি নাই।


 চিঠিখানি পড়িবা মাত্র মুহূর্তের মধ্যে চারি দিক হইতে আশার সমস্ত অবলম্বন যেন খসিয়া পড়িয়া গেল, শরীরের সমস্ত স্নায়ু পেশী যেন একেবারেই হাল ছাড়িয়া দিল, নিশ্বাস লইবার জন্য যেন বাতাসটুকু পর্যন্ত রহিল না, সূর্য তাহার চোখের উপর হইতে সমস্ত আলো যেন তুলিয়া লইল। আশা প্রথমে দেয়াল, তাহার পর আলমারি, তাহার পর চৌকি ধরিতে ধরিতে মাটিতে পড়িয়া গেল। ক্ষণকাল পরে সচেতন হইয়া চিঠিখানা আর-একবার পড়িতে চেষ্টা করিল, কিন্তু উদ্ভ্রান্তচিত্তে কিছুতেই তাহার অর্থ গ্রহণ করিতে পারিল না— কালো-কালো অক্ষরগুলা তাহার চোখের উপর নাচিতে লাগিল। এ-কী। এ কী হইল। এ কেমন করিয়া হইল। এ কী সম্পূর্ণ সর্বনাশ। সে কী করিবে, কাহাকে ডাকিবে, কোথায় যাইবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। ডাঙার উপরে উঠিয়া মাছ যেমন খাবি খায়, তাহার বুকের ভিতরটা তেমনি করিতে লাগিল। মজ্জমান ব্যক্তি যেমন কোনো-একটা আশ্রয় পাইবার জন্য জলের উপরে হস্ত প্রসারিত করিয়া আকাশ খুঁজিয়া বেড়ায়, তেমনি আশা মনের মধ্যে একটা যা-হয় কিছু প্রাণপণে আঁকড়াইয়া ধরিবার জন্য একান্ত চেষ্টা করিল, অবশেষে বুক চাপিয়া উর্ধ্বশ্বাসে বলিয়া উঠিল, “মাসিমা!”

 সেই স্নেহের সম্ভাষণ উচ্ছ্বসিত হইবা মাত্র তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। মাটিতে বসিয়া কান্নার উপর কান্না, কান্নার উপর কান্না যখন ফিরিয়া ফিরিয়া শেষ হইল, তখন সে ভাবিতে লাগিল, ‘এ চিঠি লইয়া আমি কী করিব।’ স্বামী যদি জানিতে পারেন এ চিঠি আমার হাতে পড়িয়াছে, তবে সেই উপলক্ষে তাঁহার নিদারুণ লজ্জা স্মরণ করিয়া আশা অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইতে লাগিল। স্থির করিল, চিঠিখানি সেই ছাড়া জামার পকেটে পুনরায় রাখিয়া জামাটি আলনায় ঝুলাইয়া রাখিবে, ধোবার বাড়ি দিবে না।

 এই ভাবিয়া চিঠি হাতে সে শয়নগৃহে আসিল। ধোবাটা ইতিমধ্যে ময়লা কাপড়ের গাঁঠরির উপর ঠেস দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মহেঞ্জের ছাড়া জামাট তুলিয়া লইয়া আশা তাহার পকেটে চিঠি পুরিবার উদযোগ করিতেছে, এমন সময় সাড়া পাইল, “ভাই বালি!”