পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪২
চোখের বালি

 তাড়াতাড়ি চিঠি ও জামাটা খাটের উপরে ফেলিয়া সে তাহা চাপিয়া বসিল। বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিয়া কছিল, “ধোবা বড়ো কাপড় বদল করিতেছে। যে কাপড়গুলায় মার্কা দেওয়া হয় নাই সেগুলা আমি লইয়া যাই।”

 আশা বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। পাছে মুখের ভাবে সকল কথা স্পষ্ট প্রকাশ পায়, এইজন্য সে জানালার দিকে মুখ ফিরাইয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল; ঠোঁটে ঠোঁট চাপিয়া রছিল, পাছে চোখ দিয়া জল বাহির হইয়া পড়ে।

 বিনোদিনী থমকিয়া দাড়াইয়া একবার আশাকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল। মনে মনে কছিল, ‘ও বুঝিয়াছি। কাল রাত্রের বিবরণ তবে জানিতে পারিয়াছ! আমার উপরেই সমস্ত রাগ! যেন অপরাধ আমারই!’

 বিনোদিনী আশার সঙ্গে কথাবার্তা কহিবার কোনো চেষ্টাই করিল না। খানকয়েক কাপড় বাছিয়া লইয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেল।

 বিনোদিনীর সঙ্গে আশা যে এতদিন সরলচিত্তে বন্ধুত্ব করিয়া আসিতেছে, সেই লজ্জা নিদারুণ দুঃখের মধ্যেও তাহার হৃদয়ে পুঞ্জীকৃত হইয়া উঠিল। তাহার মনের মধ্যে সখীর যে আদর্শ ছিল সেই আদর্শের সঙ্গে নিষ্ঠুর চিঠিখানা আর-একবার মিলাইয়া দেখিবার ইচ্ছা হইল।

 চিঠিখান খুলিয়া দেখিতেছে, এমন সময় তাড়াতাড়ি মহেন্দ্র ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। হঠাৎ কী মনে করিয়া কালেজের একটা লেকচারের মাঝখানে ভঙ্গ দিয়া সে ছুটিয়া বাড়ি চলিয়া আসিয়াছে।

 আশা চিঠিখানা অঞ্চলের মধ্যে লুকাইয়া ফেলিল। মহেন্দ্রও ঘরে আশাকে দেখিয়া একটু থমকিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর ব্যগ্র দৃষ্টিতে ঘরের এ দিক - ও দিক চাহিয়া দেখিতে লাগিল। আশা বুঝিয়াছিল, মহেন্দ্র কী খুঁজিতেছে; কিন্তু কেমন করিয়া সে হাতের চিঠিখানা অলক্ষিতে যথাস্থানে রাখিয়া পালাইয়া যাইবে, ভাবিয়া পাইল না।

 মহেন্দ্র তখন একটা একটা করিয়া ময়লা কাপড় তুলিয়া তুলিয়া দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্রের সেই নিষ্ফল প্রয়াস দেখিয়া আশা আর থাকিতে পারিল না, চিঠিখানা ও জামাটা মেঝের উপর ফেলিয়া দিয়া ডান হাতে থাটের থামটা ধরিয়া সেই হাতে মুখ লুকাইল। মহেন্দ্র বিদ্যুদবেগে চিঠিখানা তুলিয়া লইল। নিমেষের জন্য স্তব্ধ হইয়া আশার দিকে চাহিল। তাহার পরে আশা সিঁড়ি দিয়া মহেন্দ্রের দ্রুত ধাবনের শব্দ শুনিতে পাইল।