পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৫৫

কথা― যে সুদীর্ঘ কাহিনী নানা বর্ণে চিত্রিত, জলে স্থলে পর্বতে নদীতে বিভক্ত, মানচিত্রের মতো তাহার মনের মধ্যে গুটানো ছিল— বিহারী প্রসারিত করিয়া ধরিল। যে ক্ষুদ্র জগৎটুকুর উপর সে তাহার জীবনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তাহা কোন্‌খানে কোন্ দুর্‌গ্রহের সহিত সংঘাত পাইল, তাহাই সে মনে করিয়া দেখিতে লাগিল। প্রথমে বাহির হইতে কে আসিল। সূর্যাস্তকালের করুণ রক্তিমচ্ছটায় আভাসিত আশার লজ্জামণ্ডিত তরুণ মুখখানি অন্ধকারে অঙ্কিত হইয়া উঠিল, তাহার সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল-উৎসবের পুণ্যশঙ্খধ্বনি তাহার কানে বাজিতে লাগিল। এই শুভগ্রহ অদৃষ্টাকাশের অজ্ঞাত প্রান্ত হইতে আসিয়া দুই বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়াইল― একটু যেন বিচ্ছেদ আনিল, কোথা হইতে এমন একটি গূঢ় বেদনা আনিয়া উপস্থিত করিল যাহা মুখে বলিবার নহে, যাহা মনেও লালন করিতে নাই। কিন্তু তবু এই বিচ্ছেদ, এই বেদনা, অপূর্ব স্নেহ-রঞ্জিত মাধুর্যরশ্মির দ্বারা পরিপূর্ণ হইয়া রহিল।

 তাহার পরে যে শনিগ্রহের উদয় হইল― বন্ধুর প্রণয়, দম্পতির প্রেম, গৃহের শান্তি ও পবিত্রতা একেবারে ছারখার করিয়া দিল, বিহারী প্রবল ঘৃণায় সেই বিনোদিনীকে সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত সুদূরে ঠেলিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু, কী আশ্চর্য। আঘাত যেন অত্যন্ত মৃদু হইয়া গেল, তাহাকে যেন স্পর্শ করিল না। সেই পরমাসুন্দরী প্রহেলিকা তাহার দুর্ভেদ্যরহস্যপূর্ণ ঘনকৃষ্ণ অনিমেষ দৃষ্টি লইয়া কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে বিহারীর সম্মুখে স্থির হইয়া দাঁড়াইল। গ্রীষ্মরাত্রির উচ্ছ্বসিত দক্ষিণবাতাস তাহারই ঘন নিশ্বাসের মতো বিহারীর গায়ে আসিয়া পড়িতে লাগিল। ধীরে ধীরে সেই পলকহীন চক্ষুর জালাময়ী দীপ্তি ম্লান হইয়া আসিতে লাগিল; সেই তৃষাশুষ্ক খরদৃষ্টি অশ্রুজলে সিক্ত স্নিগ্ধ হইয়া গভীর ভাবরসে দেখিতে দেখিতে পরিপ্লুত হইয়া উঠিল; মুহূর্তের মধ্যে সেই মূর্তি বিহারীর পায়ের কাছে পড়িয়া তাহার দুই জানু প্রাণপণ বলে বক্ষে চাপিয়া ধরিল― তাহার পরে সে একটি অপরূপ মায়ালতার মতো নিমেষের মধ্যেই বিহারীকে বেষ্টন করিয়া বাড়িয়া উঠিয়া সদ্যোবিকশিত সুগন্ধি পুষ্পমঞ্জরী-তুল্য একখানি চুম্বনোন্মুখ মুখ বিহারীর ওষ্ঠের নিকট আনিয়া উপনীত করিল। বিহারী চক্ষু বুজিয়া সেই কল্পমূর্তিকে স্মৃতিলোক হইতে নির্বাসিত করিয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল; কিন্তু কোনমতেই তাহাকে আঘাত করিতে যেন তাহার হাত উঠিল না― একটি অসম্পূর্ণ ব্যাকুল চুম্বন তাহার মুখের কাছে আসন্ন হইয়া রহিল, পুলকে তাহাকে আবিষ্ট করিয়া তুলিল।