পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৬১

 ক্ষুদ্র পল্লীর মধ্যে নিজেকে সকলের কাছ হইতে গোপনে রাখিবার চেষ্টা বৃথা। এখানে আহত হৃদয়টিকে কোণের অন্ধকারে লইয়া নির্জনে শুশ্রূষা করিবার অবকাশ নাই— যেখান-সেখান হইতে সকলের তীক্ষ্ণ কৌতুহলদৃষ্টি আসিয়া ক্ষতস্থানে পতিত হয়। বিনােদিনীর অন্তঃপ্রকৃতি চুপড়ির ভিতরকার সজীব মাছের মতাে যতই আছড়াইতে লাগিল, ততই চারি দিকের সংকীর্ণতার মধ্যে নিজেকে বারংবার আহত করিতে লাগিল। এখানে স্বাধীনভাবে পরিপূর্ণরূপে বেদনাভােগ করিবারও স্থান নাই।

 দ্বিতীয় দিনে চিঠি পাইবার সময় উত্তীর্ণ হইতেই বিনোদিনী ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া লিখিতে বসিল—

 ঠাকুরপাে, ভয় করিয়াে না, আমি তােমাকে প্রেমের চিঠি লিখিতে বসি
নাই। তুমি আমার বিচারক, আমি তােমাকে প্রণাম করি। আমি যে পাপ
করিয়াছি তুমি তাহার কঠিন দণ্ড দিয়াছ; তােমার আদেশমাত্র সে দণ্ড আমি
মাথায় করিয়া বহন করিয়াছি। দুঃখ এই, দণ্ডটি যে কত কঠিন তাহা তুমি
দেখিতে পাইলে না। যদি দেখিতে, যদি জানিতে পাইতে, তাহা হইলে তােমার
মনে যে দয়া হইত তাহা হইতেও বঞ্চিত হইলাম। তােমাকে স্মরণ করিয়া, মনে
মনে তােমার দুইখানি পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া, আমি ইহাও সহ্য করিব।
কিন্তু প্রভু, জেলখানার কয়েদি কি আহারও পায় না। শৌখিন আহার নহে—
যতটুকু না হইলে তাহার প্রাণ বাঁচে না, সেটুকুও তো বরাদ্দ আছে? তােমার
দুই ছত্র চিঠি আমার এই নির্বাসনের আহার— তাহা যদি না পাই তবে
আমার কেবল নির্বাসনদণ্ড নহে, প্রাণদণ্ড। আমাকে এত অধিক পরীক্ষা
করিয়াে না, দণ্ডদাতা। আমার পাপ-মনে অহংকারের সীমা ছিল না; কাহারাে
কাছে আমাকে এমন করিয়া মাথা নােয়াইতে হইবে, ইহা আমি স্বপ্নেও
জানিতাম না। তােমার জয় হইয়াছে প্রভু; আমি বিদ্রোহ করিব না। কিন্তু
আমাকে দয়া করাে, আমাকে বাঁচিতে দাও। এই অরণ্যবাসের সম্বল আমাকে
অল্প একটু করিয়া দিয়ো। তাহা হইলে তােমার শাসন হইতে আমাকে কেহই
কিছুতেই টলাইতে পারিবে না। এইটুকু দুঃখের কথাই জানাইলাম। আর
যে-সব কথা মনে আছে, বলিবার জন্য বুক ফাটিয়া যাইতেছে, তাহা তােমাকে
জানাইব না প্রতিজ্ঞা করিয়াছি— সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিলাম।

তােমার


বিনােদ-বােঠান